প্রশান্তি ডেক্স॥ বিশ্বকাপের কত ঘটনা, অসংখ্য স্মৃতি! সব কি আর মনে থাকে? তবে দুটি দৃশ্য আর ঘটনা মনের আয়নায় জ্বলজ্বল করছে। প্রথমমটি আজ থেকে ২৩ বছর আগে পাকিস্তানের ফয়সলাবাদে। অন্যটি ২০১৫ সালের।
যেখানে দেখেছিলাম ইংলিশ অধিনায়ক, কোচ ও ক্রিকেটারদের অসহায় অবস্থা। মনে করে দেখুনতো! সেই যে ১৯৯৬ সালে ফয়সলাবাদে বিশ্বকাপের কোয়ার্টারফাইনালে দুই লঙ্কান ওপেনার জয়সুরিয়া আর কালুভিথারানার উত্তাল ‘পিঞ্চ হিটিং’।
তখন পাওয়ার প্লে’ ছিল প্রথম ১৫ ওভার। ওই ফিল্ডিং বিধিবদ্ধতা কাজে লাগিয়ে জয়সুরিয়া আর কালুভিথারানা সেবার প্রায় ম্যাচেই শুরুতে ফিল্ডারদের মাথার ওপর দিয়ে তুলে মেরে মেরে রানে চাকা সচল করতেন। আর ভাল বলকে সমীহ না দেখিয়ে অসীম সাহস আর অবিচল আস্থায় ‘দুম’ করে মেরে পাঠিয়ে দিতেন বাউন্ডারির বাইরে। হয়ে যেতো চার কিংবা ছক্কা।
ওই বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে জয়সুরিয়ার ৪৪ বলে ১৩ বাউন্ডারি আর তিন ছক্কায় করা ৮২ রানের হ্যারিক্যান ইনিংসে দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিল ইংলিশদের বিশ্বকাপ স্বপ্ন। মাইক আথারটন বাহিনীর ২৩৫ রান টপকে ৫২ বল আগেই জয় তুলে নিয়েছিল লঙ্কানরা।
জয়সুরিয়ার সেই উত্তাল উইলোবাজি দেখে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়েই ছিলেন তখনকার ইংলিশ অধিনায়ক ও এবারের বিশ্বকাপের অন্যতম টিভি ধারাভাষ্যকার মাইক আথারটন।
খেলা শেষে প্রেস কনফারেন্সে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা বাবা এমন বলগাহীন ব্যাটিংয়ের সাথে পরিচিত নই। আমাদের কাছে ক্রিকেট মানেই ব্যাকরণ মেনে খেলা। আমরা ‘কপিবুক’ ক্রিকেটটাই রপ্ত করি। সেটা পরিবেশন ও উপস্থাপনেরও চেষ্টা করি। ভাল বলকে সমীহ দেখাই। ফরোয়ার্ড ডিফেন্স করি। আর আলগা বল পেলে ফিল্ডারদের নাগালের বাইরে দিয়ে সীমানার ওপারে পাঠোনোর চেষ্টা করি। এভাবে ভাল বলকে অনায়াসে মেরে বলের সুতো খুলে দেয়া আমরা পারি না। সে চেষ্টাও নেই আমাদের।’
এমন না হলেও ২০১১ সালে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ আর শফিউল ইসলামের দৃঢ়তায় ইংলিশদের পরাজয়ের পরও দেখেছিলাম ইংলিশদের সে কি অসহায় অবস্থা!
এরপর ২০১৫ সালের ৯ মার্চ অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেইডে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের সংগ্রামী সেঞ্চুরি (১৩৮ বলে ১০৩), মুশফিকুর রহীমের ঝড়ো ব্যাটিং (৭৭ বলে ৮৯) আর পেসার রুবেল হোসেনের দুটি এক্সপ্রেস ডেলিভারির কাছেই মুখ থুবড়ে পড়েছিল ইংল্যান্ড। রোববার লর্ডসে যার হাতে উঠলো বিশ্বকাপ, সেই ইয়ন মরগ্যানই ছিলেন ওই ম্যাচে ইংলিশ ক্যাপ্টেন। সে ম্যাচে পেসার রুবেলের বলে শূন্য রানে ফিরে গিয়েছিলেন মরগ্যান।
সে দিনও কি যে অসহায় মনে হয়েছিল তাকে! কিন্তু চার বছর পর সেই মরগ্যানের মুখে হাসি। বিশ্বজয়ের উল্লাস। নিজেদের খোলস পাল্টে বিশ্বসেরা হওয়ার আনন্দ চোখে মুখে।
এই যে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের মানসিকতা, খেলার ধরণ, অ্যাপ্রোচ-অ্যাপ্লিকেশন পাল্টে বিশ্বসেরা হওয়া- সেটাও কিন্তু রীতিমত কল্প-কাহিনীকে হার মানায়। যে দল শেষ দুই বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বের বেড়াই টপকাতে পারেনি, তারাই এবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। নতুন বিশ্বসেরা ।
অথচ সবার জানা ইংলিশ ক্রিকেট মানেই যে পরিশুদ্ধ ব্যাটিং। একদম ব্যাকরণ মেনে বলের লাইনে শরীর ও পা নিয়ে খেলা। ভাল বলকে সমীহ দেখানো আর খারাপ বা আলগা বল পেলেই শটস খেলা। সেটাও যতটা পাওয়ার খাটিয়ে সজোরে চার বা ছক্কা হাঁকানোর চেয়ে ফিল্ডারদের নাগালে বাইরে ঠেলে দেয়া- সংক্ষেপে এটাই ছিল ইংরেজদের প্রথাগত ব্যাটিং অ্যাপ্রোচ।
কিন্তু কালের আবর্তে ইংলিশরাও সে ধারা থেকে সরে এসেছে। বিশেষ করে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশের কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে খালি হাতে বিদায়ের পর তাদের বিলম্বিত বোধোদয় হয়, ‘নাহ! এভাবে আর ব্যাকরণ মেনে পরিশুদ্ধ ব্যাটিং করলে চলবে না। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। এখনকার যে কার্যকর আর লাগসই কৌশল, আক্রমণাত্মক মানসিকতা এবং ব্যাকরণের বাইরের প্রচুর শট এবং বাড়তি ‘পাওয়ার হিটিং’ করে খেলতে হবে।’
গত রোববার ফাইনাল শেষে প্রেস কনফারেন্সে সেই নিজেদের পালাবদল ও নতুন পথে হেঁটে সাফল্যর নাগাল পাওয়ার কাহিনীই শোনালেন ইয়ন মরগ্যান।
এতটুকু ভনিতা না করে অবলীলায় বলে ফেলেছেন, ‘গত চার বছরে আমরা নিজেদের তিলে তিলে তৈরি করেছি। প্রচুর হার্ডওয়ার্ক করেছি। এবারের বিশ্বকাপ ঘরের মাঠে হবে। চেনা-জানা পরিবেশ। তারপরও আমরা দল হিসেবে গড়ে ওঠার চেষ্টা করেছি সাধ্যমত। এছাড়া এখনকার ক্রিকেট উপযোগি করে নিজেদের গড়ে তোলার দৃঢ় সংকল্পও ছিল আমাদের।’
তিনি আরও বলেন, ‘ব্যাটিং, বোলিং আর ফিল্ডিং- তিন বিভাগেই সময়ের প্রয়োজনে যা যা করার, তাও করার প্রানান্ত চেষ্টা ছিল আমাদের। সর্বোপরি গত চার বছরে এমন একটা সেট আপ দাঁড় করানোর চেষ্টা ছিল যে, দল সময়ের দাবি মেটাতে পারে। করণীয় কাজগুলো নিজেদের মত করে করার সামর্থ্য রাখে।’
সত্যিই তাই। ইংল্যান্ড এখন সময়ের অন্যতম সেরা দল। আইসিসি র্যাংকিংয়েও শীর্ষে। তাদের অ্যাপ্রোচ-অ্যাপ্লিকেশন আগের যে কোন সময়ের আগ্রাসী, আক্রমণাত্মক এবং সব সময় পজিটিভ।
জেসন রয়, বেয়ারেস্টো, জো রুট, মরগ্যান, বাটলার আর বেন স্টোকসরা সত্যিই অনেক বেশি পজিটিভ মানসিকতার । সেই সাথে আক্রমণাত্মক। আগের মত ওই খারাপ আর আলগা বলের অপেক্ষায় না থেকে সেগুলোকে ‘গ্যাপে ঠেলার’ চেষ্টায় না গিয়ে তারা এখন উত্তাল উইলোবাজি রপ্ত করে ফেলেছেন। এখন বিশ্বের যে কোন বোলিং শক্তির বিপক্ষে সাহস, শারীরিক শক্তি আর হাত খুলে শটস খেলার ইচ্ছে ও পারদর্শীতায় এখন ইংলিশরা কারো চেয়ে কম নয়। বরং ওপরে।
আর সেই হাত খুলে খেলাটাই তাদের এনে দিল বিশ্বসেরা গৌরব ও সম্মান। ৫০ ওভারের পর সুপার ওভারেও স্কোর লাইন সমান সমান। কি করা! ফল নিষ্পত্তির জন্য বেছে নেয়া হলো কোন দল বেশি বাউন্ডারি হাঁকিয়েছে, তাদের। বেশি বাউন্ডারি হাকানোর সুবাদেই চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড। সেটাও তাদের ব্যাটসম্যানদের ফ্রি স্ট্রোক খেলার প্রবণতা বাড়া এবং আক্রমণাত্মক শটস খেলার সামর্থ্যেরই প্রমাণ্য দলিল।
আর পাশাপাশি ফাস্ট বোলিং যে শুধু মাত্র লাইন-লেন্থ আর সুইং নির্ভর নয়। বাড়তি গতি সঞ্চার এবং বোলিংয়ে বৈচিত্র্যের মিশেলটাও যে আজকাল সাফল্যের অন্যতম হাতিয়ার, ইয়র্কার, ওয়াইড ইয়র্কার আর লো ফুল টচ- যে এখন অনেক বেশি কার্যকর। জোফরা আর্চারের শেষ ওভারও যে তার প্রমাণ। আসলে শেষ পর্যন্ত সেটাই ইংলিশদের সাফল্যর মূল। আর বোলাররাও আগের চেয়ে অনেক বেশি অ্যাগ্রেসিভ।
আগের ইংলিশ ফাস্ট বোলিং ছিল নিয়ন্ত্রিত। তারা কন্ডিশন কাজে লাগিয়ে ছোট ছোট সুইংয়ে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে সমীহ আদায়ের চেষ্টা করতেন। এখন সে ধারা বদলেছে। ক্রিস ওকস, জোফরা আর্চার, লিয়াম প্লাঙ্কেট আর মার্ক উডরা অনেক বেশি ধারালো।
লাইন লেন্থের পাশাপাশি তারা বাড়তি গতি সঞ্চার করেছেন। সবাই বেশ জোরে বল করেন, আর্চারসহ অন্তত দুই ইংলিশ বোলার গড় পড়তা ১৪০ কিলোমিটার গতিতে বল করেন প্রায় পুরো ১০ ওভার। বাড়তি গতিতে বল করাই শুধু নয়, সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানকে ঠান্ডা রাখার মূল অস্ত্র সুইংটাও রপ্ত রয়েছে প্রায় সব ইংলিশ ফাস্ট বোলারের। ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্বর্ণ সময়ের ফাস্ট বোলার আর অস্ট্রেলিয়ানদের মত এখন ইংলিশ ফাস্ট বোলাররাও বাউন্সার ছুড়ে আর ইয়র্কারে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের ব্যাতিব্যস্ত রাখেন।
সেই সাথে ফিল্ডিং অ্যাপ্রোচটাও পাল্টেছে অনেক। মাঠে চিরায়ত ব্যাকরণ মেনে ফিল্ডিং করার পাশাপাশি এখন অনেক বেশি চোস্ত ও শারীরিকভাবে ফিট ইংলিশরা। তাদের রানিং এবং বল তাড়া করা এক পিকআপে বল ধরা ও একই অ্যাকশনে কিপার বা বোলারের হাতে বল ছুড়ে দেয়ার কাজগুলোও অনেক ভালো রপ্ত করে ফেলেছেন ইংলিশরা।
আর তাইতো ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে নিজেদের বদলে ফেলে এখন মরগ্যানের দল বিশ্বসেরা। দুঃখজনক হলেও সত্য, ২০১৫ সালে বাংলাদেশের কাছে হেরে খাদের কিনারায় পড়ে যাওয়া ইংলিশরা ধ্বংস্তুপ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বিশ্ব সেরা হলো, কাল প্রেস মিটে বাংলাদেশের নাম মুখে উচ্চারন না করেও ইংলিশ অধিনায়ক মরগ্যানও তেমন কথাই বললেন।
তাহলে বাংলাদেশ কি করলো? চার বছরে কতটা এগিয়েছে টাইগাররা? ঘরের মাঠে পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা আর ভারতকে হারানোর চার বছর আগে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা টাইগারা শেষ পর্যন্ত দেশে ফিরে এসেছেন তিন ম্যাচ জিতে আট নম্বর হয়ে।
ইংলিশরা যদি বাংলাদেশের কাছে হেরে নিজেদের শুধরে আর বদলে ফেলে ঝরঝরে তরতাজা, উদ্যমী ও তেজোদ্দীপ্ত করে তুলে বিশ্ব সেরা হতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ কেন পারবে না? সে সত্য অনুভব ও ওই পথে হাঁটার যে এখনই সময়।