প্রশান্তি ডেক্স॥ বাসচাপায় পা হারানো রাসেল সরকারকে ৫০ লাখ টাকার বাকি ৪৫ লাখ টাকা গ্রীনলাইন পরিবহন কর্তৃপক্ষকে দিতেই হবে। তবে, একসঙ্গে না দিয়ে ৯ কিস্তিতে প্রতি মাসে পাঁচ লাখ টাকা করে পরিশোধ করতে বলেছেন হাইকোর্ট।
গ্রীনলাইন পরিবহনের মালিকের পক্ষে আদালতে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ কামানো এবং কিস্তিতে পরিশোধের একটি আবেদন করা হয়েছিল আদালতে। আদালত টাকা কমানোর আর্জি নাকোচ করে ৯টি কিস্তিতে ৫ লাখ টাকা করে টাকা পরিশোধ করতে বলেছেন।
শুনানিকালে আদালত বলেন, ‘ক্ষতিপূরণের অর্থ হ্রাস করার কোনো সুযোগ নেই।’ কিস্তিতে অর্থ পরিশোধ করতে হবে।
এ সময় আদালত গ্রীন লাইনের আইনজীবীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘যারা আদালতের আদেশ লঙ্ঘন করার ফন্দিফিকির করে সরকার তাকে কীভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে তা আমরা দেখবো।’ আদালত ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আপনারা যথেষ্ট বেয়াদবি করেছেন। আপনাদের আচরণ কোনোভাবেই শোভনীয় নয়।’
গ্রীনলাইন পরিবহনের চাপায় পা হারানো রাসেল সরকারের ক্ষতিপূরণের রিটের ওপর শুনানিতে আজ (মঙ্গলবার) হাইকোর্টের বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এসব কথা বলেন।
আদালত কড়া ভাষায় আরও বলেন, ‘আপনারা যা ইচ্ছা তা করতে পারেন, হরতাল অবরোধও করতে পারেন। আপনারা যথেষ্ট বেয়াদবি করেছেন।’ আমাদের অনুরাগ-বিরাগের ঊর্ধ্বে থাকতে হবে, কারণ আমরা শপথ নিয়েছি। আদালত আরো বলেন, আপনারা মনে রাখবেন সেও (রাসেল সরকার) পরিবহন শ্রমিকের বাইরে না। রাসেলও একজন গাড়িচালক।
আদালতে আজ গ্রীন লাইনের মালিকের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো. ওজি উল্লাহ। রিট আবেদনকারীর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী খোন্দকার শামসুল হক রেজা। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ বি এম আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এম সাইফুল আলম। বিআরটিএর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মোহাম্মদ রাফিউল ইসলাম। ক্রাচে ভর দিয়ে আজ আদালতে উপস্থিত হন রাসেল সরকার।
এর আগে গত ২২ মে হাইকোর্ট নির্দেশনা বাস্তবায়নের অগ্রগতির ওপর আদেশের জন্য আজকের (২৫ জুন) দিন ধার্য করেছিলেন। ধার্য দিনের শুনানিতে ক্ষতিপূরণের টাকা না দেওয়ার তথ্য জানানোর পর আজ আদালত এসব কথা বলেন।
শুনানিতে আদালত গ্রীণলাইন পরিবহনের মালিকের আইনজীবীকে উদ্দেশ করে বলেন, ওজিউল্লাহ সাহেব আপনি কী বলছেন। আপনার মূল সাবমিশনটা কী বলেন।
আইনজীবী ওজিউল্লাহর কাছে জানতে চান আপনারা কতো টাকা দিয়েছেন? জবাবে আইনজীবী ওজিউল্লাহ বলেন, চিকিৎসা বাবদ সাড়ে ৩ লাখ টাকা দিয়েছি। এ ছাড়াও ৫ লাখ টাকার চেকে দেওয়া হয়েছে।
এ সময় আদলত বলেন, ‘আপনারা অসহায় এ ছেলেটার একটা ব্যবস্থা করতে পারতেন। খোঁজ-খবর নিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে সমঝোতা করতে পারতেন। কোনো না কোনোভাবে সহযোগিতা করতে পারতেন। স্বাভাবিক মানবতাবোধ দেখাতে পারতেন। আপনাদের আচরণ শোভনীয় নয়।’
আজ রাসেলকে কোনো টাকা দেওয়া হয়েছে কি না বিচারক জানতে চাইলে গ্রীনলাইনের আইনজীবী নীরব থাকেন, এ পর্যায়ে রিটকারী আইনজীবী খন্দকার সামসুল হক রেজা বলেন, ‘তারা আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন করেনি। এমনকি কীভাবে ক্ষতিপূরণ দেবে তাও জানায়নি। প্রতিদিন তাদের এক কোটি টাকা আয় হয়।’
আদালত গ্রীনলাইনের আইনজীবীকে বলেন, ‘আপানারা তো দেওলিয়া হয়ে যাননি। কিছু টাকা দিলে কী হত। ছেলেটার সামনে এখনও অনেক সময় পড়ে আছে।’
এ পর্যায়ে বিআরটিএ’র আইনজীবী রফিউল ইসলাম রাফি রুলের জবাব হলফনামা আকারে দাখিল করে বলেন, ‘বিআরটিএ ২০০৩ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে কমিটি গঠন করেছে। এ কমিটির কার্যক্রম এখনো চলছে।’
তখন আদালত বলেন, ‘আমরা কমিটর কথা শুনতে চাচ্ছি না। কমিটির কথা বাদ দেন। আমরা অ্যাকশন দেখতে চাচ্ছি। সড়কে এখনো বিশৃঙ্খলা রয়েছে। কোথাও ট্রাফিক সিগনাল দেখছি না, গতিবেগ নিয়ন্ত্রণের কিছু দেখছি না।’
আদালত বলেন, ‘এবারের ঈদে অন্তত ৪৭ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আহত হয়েছেন সাতশ জনের মত। আপনারা কিসের নিরাপত্তা দিচ্ছেন? এখন পর্যন্ত ড্রাইভারদের যোগ্যতাই নির্ধারণ করতে পারেন নাই। ড্রাইভাররা বেপরোয়া গাড়ি চালাচ্ছে। বিআরটিএর আইনজীবী আবারও বলেন, আমরা কমিটি করেছি।
কোর্ট বলেন, গতানুগতিক কথাবার্তা ছাড়া কিছুই নাই এখানে। প্রতিদিন সড়কে -১০ জন করে মানুষ মারা যাচ্ছে। বিআরটিএ কিছু করতে পারছে না।’
এর আগে গত ২২ মে ক্ষতিপূরণের বাকি ৪৫ লাখ টাকা পরিশোধের জন্য আজকের (২৫ জুন) দিন পর্যন্ত সময় দেন আদালত। কিন্তু গ্রীনলাইন কর্তৃপক্ষ টাকা পরিশোধ না করে আজ ক্ষতিপূরণের টাকা কমানোর জন্য হাইকোর্টে আবেদন করেন। এর আগে গত ১০ এপ্রিল রাসেল সরকারকে আদালতের মাধ্যমে ৫০ লাখ টাকার মধ্যে পাঁচ লাখ টাকার চেক হস্তান্তর করে গ্রীনলাইন কর্তৃপক্ষ। গত ১২ মার্চ রাসেল সরকারকে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
গত বছর ২৮ এপ্রিল মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারে কথা কাটাকাটির জেরে গ্রীনলাইন পরিবহনের বাসচালক ক্ষিপ্ত হয়ে প্রাইভেটকার চালকের ওপর দিয়েই বাস চালিয়ে দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই প্রাইভেটকার চালক রাসেল সরকারের (২৩) বাম পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
পা হারানো রাসেল সরকারের বাবার নাম শফিকুল ইসলাম। গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে। ঢাকার আদাবর এলাকার সুনিবিড় হাউজিং এলাকায় তার বাসা। এ ঘটনায় সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য উম্মে কুলসুম স্মৃতি হাইকোর্টে এ রিট আবেদন করেন। পরে আদালত রিটের শুনানি নিয়ে রুল জারি করেন।