মনিটরে ছবি দেখামাত্রই রেণুর দুই সন্তান বলছে, এইতো আমাদের মা

প্রশান্তি ডেক্স॥ শত শত খেলনার ভিড়েও মাকে খুঁজছে বাড্ডায় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত তাসলিমা বেগম রেণুর অবুঝ দুই সন্তান মাহির আর তুবা। নতুন নতুন খেলনা পেয়ে কয়েক মিনিটের জন্য খুশি হচ্ছে দুই শিশু। আবার পরক্ষণেই ভুলে যাচ্ছে খেলনার কথা। মায়ের কথা মনে করে শুধু শুধুই বাসার কম্পিউটারের সামনে গিয়ে হাজির হচ্ছে। কম্পিউটারের মনিটরে রেণুর ছবি থাকায় দুই সন্তান বার বার সেখানেই যাচ্ছে। যেন কম্পিউটারের মনিটরেই মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে দুই শিশু।monetore chobe dekhe ranor dow shontan
মনিটরে ছবি দেখামাত্রই দুই শিশু বলছে, এইতো আমাদের মা। মানুষ আমাদের মাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। বলেই হাউমাউ করে কাঁদছে। দুই শিশুর মায়ের জন্য এমন আকুতি আর অনুভূতি যেন সবাইকে নাড়িয়ে যাচ্ছে। বাসার প্রত্যেকটি লোকের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নষ্ট হয়ে গেছে। প্রতিদিন শত শত মানুষ ভিড় করছেন মহাখালীর বাড়িতে। সবাই অশ্রুসজল চোখে বিদায় নিচ্ছেন। বাচ্চা দুইটি বর্তমানে তার খালা স্কুল শিক্ষিকা নাজমুন নাহার নাজমার কাছে রয়েছে।
শনিবার চারটার দিকে মহাখালী ওয়্যারলেস গেটের কাছে গিয়ে রেণুদের বাসা খুঁজতে তেমন বেগ পেতে হলো না। একজন নারী দোকানিকে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি দোকান থেকে নেমে রেণুর বাসা দেখিয়ে দিলেন। বাড়িটির তিন তলায় নাজমা পরিবারের সঙ্গে বসবাস করেন।
বাসায় ঢুকতেই দেখা গেল, ছোট্ট ফুটফুটে নিহত রেণুর চার বছরের মেয়ে তুবা ঘরে ছোটাছুটি করছে। এ ঘর থেকে সে ঘর, দুরন্ত গতিতে ছুটে বেড়াচ্ছে। দৌড়ের মাঝেই সরাসরি সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে কম্পিউটারের মনিটরের সামনে। কম্পিউটারের মনিটরটি তখন বন্ধ ছিল। সে কি ভীষণ রাগ! তোমরা আমার আম্মুর ছবি ঢেকে রেখেছ কেন? এখনই কম্পিউটার চালাও। আমি আম্মুকে দেখব। তার বায়না এতটাই আবেগী আর হৃদয় স্পর্শ করে যাচ্ছিল যে, যে কারও পক্ষেই সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন। উপস্থিত লোকজনের চোখ থেকে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়ছিল। যথারীতি তার কথামতো কম্পিউটার খোলা হলো। স্ক্রিনে তার মায়ের ছবি ভেসে ওঠল। তুবা বলছিল, এইতো আমার মা। এরপর সে মা মা বলে ডাকতে শুরু করল। তখন উপস্থিত সবাই আর কান্না ধরে রাখতে পারছিল না। তুবা বলছিল, মানুষ আমার মাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। আমার মা মরে গেছে। আমি কার কাছে থাকব? নিষ্পাপ শিশুর এমন আর্তিতে পুরো পরিবেশ ভারি হয়ে যাচ্ছিল। তারপরও পরিবারের সদস্যরা তুবাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। খানিক পরে মনটা ভীষণ খারাপ করে অন্য আরেকটি রুমে চলে গেছে।
এদিকে রেণুর একমাত্র ছেলে মাহির পুরোপুরি পাথর হয়ে গেছে। এগারো বছর বয়সী এই ছেলে আড় চোখে কম্পিউটারের মনিটরের দিকে তাকাচ্ছিল। আর অঝোরে কাঁদছিল। বার বার চোখের পানি মুছছিল। মাহিরের নীরব কান্নায় সবাই যেন রীতিমতো বোবা হয়ে গিয়েছিল। মাহিরের সঙ্গে অনেক কথা বলার পরেও, মাহির কোন প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। শুধুই কাঁদছিল। মাঝে মধ্যেই অতটুকু বাচ্চা দীর্ঘশ্বাস ফেলছিল। যখনই তার মাথায় আর পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করা হচ্ছে, তখনই সে অঝোরে কাঁদছে। তার নীরব কান্না সবাইকে কাঁদিয়ে যাচ্ছিল।
বিকেল সাড়ে চারটার দিকে রেণুর আত্মীয়স্বজনরা তুবা আর মাহিরের জন্য অনেক নতুন নতুন কাপড়, খেলনা, চকোলেটসহ নানা কিছু নিয়ে আসেন। তুবাকে অন্য ঘর থেকে তার জন্য অনেক আনন্দের জিনিস আনা হয়েছে বলে ডেকে আনা হয়। স্বজনরা রীতিমতো হৈ চৈ করে দুই শিশুদের আনন্দ যোগানোর চেষ্টা করছিলেন। তুবা প্রথম প্রথম বেশ কয়েকটি জামা বেছে নিল। এরপর তার একটি পরিয়ে দেয়ার জন্য বায়না করল। যথারীতি পরিয়ে দেয়াও হল। মিনিট তিনেক পরেই তুবা আবার সেই মাকে খুঁজতে থাকে। তার চোখ সব সময় কম্পিউটারের মনিটরের দিকে। তার কারণে কম্পিউটারের মনিটর বন্ধ করা যায় না। মা মা করতে করতে আর কম্পিউটারের মনিটরে মাকে দেখতে দেখতেই এক সময় ক্লান্ত দেহে ঘুমিয়ে পড়ে দুই শিশু। মায়ের জন্য দুই অবুঝ শিশুর এমন হৃদয়বিদারক আকুতি শুধু মহাখালীর ওয়্যারলেস গেট এলাকার মানুষের নয়, সারাদেশের মানুষকে আবেগতাড়িত করছে।
প্রসঙ্গত, গত ২০ জুলাই সকাল সাড়ে আটটার দিকে রাজধানীর উত্তর বাড্ডার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সন্তানদের ভর্তির বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন রেণু। বোরখা পরিহিত রেণু বেগমের বাসা মহাখালী জানার পর মানুষের মধ্যে তাকে নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে স্কুলে ছেলেধরা ধরা পড়েছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। সেই গুজবের রেশ ধরে শত শত মানুষ স্কুলটিতে ভিড় করে। তারা ছেলেধরা ভেবে রেণুকে গণপিটুনি দেয়। আর তাতেই মর্মান্তিকভাবে রেণুর মৃত্যু হয়।
রেণুর পরিবারের জন্য ৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে রিট উত্তর বাড্ডায় সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে গণপিটুনিতে তাসলিমা বেগম রেণু নিহত হওয়ার ঘটনায় তার পরিবারের জন্য পাঁচ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে রিট দায়ের করা হয়েছে। অন্যদিকে সম্পত্তির লোভে ৭০ বছরের অসুস্থ বৃদ্ধা মা ছায়াতুনন্নেছাকে তালাবদ্ধ করে রাখা মেয়ের কাছ থেকে উদ্ধারের যথাযথ নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছে একমাত্র ছেলে মোঃ জাহিদ রহমান রুবেল। রবিবার হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ রিট দুটি করা হয়। অন্যদিকে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির সংশ্লিষ্টদের ছাড়া কেউ জনস্বার্থে রিট করতে পারবে না। এখন থেকে নিহত ও আহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ নিতে হলে পরিবারের সদস্যদের মামলা করতে হবে। এদিকে এনটিআরসিএ’র জাতীয় মেধা তালিকায় থাকা শিক্ষক নিবন্ধনধারী রিটকারীদের নিয়োগ না দিয়ে নতুন করে ১৬তম পরীক্ষার সার্কুলার জারি করা কেন বেআইনী ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট।
রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে গণপিটুনিতে তাসলিমা বেগম রেণু নিহত হওয়ার ঘটনায় তার পরিবারকে পাঁচ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে রিট দায়ের করা হয়েছে। তাৎক্ষণিক ক্ষতিপূরণ হিসেবে তার পরিবারকে পনেরো দিনের মধ্যে দশ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে রিটে। জনস্বার্থে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট আবেদনটি করেন সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান। রিট আবেদনে গণপিটুনি থেকে তাসলিমা বেগম রেণুকে বাঁচাতে বিবাদীদের ব্যর্থতা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানাতে রুল চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি গণপিটুনি নিয়ে আইন তৈরির নির্দেশনার আর্জি রয়েছে। রিটে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব, তথ্য সচিব, পুলিশের আইজি, ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার ও বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) বিবাদী করা করা হয়েছে।
এদিকে সম্পত্তির লোভে ৭০ বছরের অসুস্থ বৃদ্ধা মা ছায়াতুনন্নেছাকে তালাবদ্ধ করে রাখা মেয়ের কাছ থেকে উদ্ধারের যথাযথ নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছেন একমাত্র ছেলে মোঃ জাহিদ রহমান রুবেল। রবিবার দুপুরে ছেলে রুবেলের পক্ষে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ রিট আবেদন করেন সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী মোঃ জে আর খান রবিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.