শিশু নির্যাতক আপন ঘরেরই লোক

প্রশান্তি ডেক্স॥ তখন আমরা মেয়ে ইশকুলে পড়ি । শবে বরাতে কার হাতে মেহেদি কত লাল হলো সেইসব মিলিয়ে দেখি হাতে হাতে। কার মা কত সুন্দর, কার চুল কত লম্বা সেইসব পাল্লা দিই। কে কতক্ষণ দম রাখতে পারে বৌচি খেলার সময়, সেটাও মেলাই এর ওর সাথে। আস্তে আস্তে আমাদের মিলিয়ে দেখবার বিষয় বদলাতে থাকে। আমরা টের পাই। আমরা হিসেব করি কে কতটা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে বাড়িতে – না, না বেত টেত নয়, এই নির্যাতনের ধারা আলাদা। এটা যে নির্যাতন তা আমরা সবাই কেমন কেমন করে বুঝে গেছি, কেউ তবু নালিশ করতে পারছি না, এমনকি মায়ের কাছেও না। শিশু আর নারী: আত্মীয়স্বজন নিরাপদ নয়, স্কুল নিরাপদ নয়, খেলার আঙিনা নিরাপদ নয়। বিপদ আসে পরিবার থেকেই আমাদের gorear look  পৃথিবী জগতের অলক্ষ্যে বদলাতে থাকে। আর আমরা বুঝে যাই বিপদ আসে নিজের পরিবারের আশপাশ থেকেই। ছাদের ঘরে বা চিলেকোঠায় শুয়ে যে মামা বুকে রেডিও রেখে অনুপ ঘোষালের গান শুনছে তার কাছ থেকে। যে চাচা ভাইঝিদের কাপড় বদলাবার সময় ইচ্ছে করে সে’ঘরে ঢুকে যাচ্ছে তার কাছ থেকে। যে দূরসম্পর্কের ফুফাতো ভাই/দাদা বিয়ে বাড়ির ঢালাও বিছানায় অদূরে ঘুমিয়েছে তার কাছ থেকে। ম্রিয়মাণ আলো জ্বলা ঘরে কোলে বসিয়ে যে দাদু অশেষ আদরে চন্দ্রপুলি খেতে দিয়েছে তার কাছ থেকে। যে দুলাভাই ‘দেখি দেখি কেমন সূচের কাজ করেছিস জামার বুকে’ বলে ওড়না সরিয়ে দেয় তার কাছ থেকে। যে আরবি হুজুর শুক্রবার সকালে আমপারা পরাবার পরে দেখাচ্ছে মেয়েরা নামাজে কেমন করে হাত দিয়ে বুক বাঁধে তার কাছ থেকে। শশু ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আমরা দেখতে পেলাম — আমাদের হাতের পাতা মেহেদিবাটা লাগিয়ে রক্তিম হচ্ছে সেটিই শুধু আমাদের একমাত্র মিল নয়, আমাদের লুকিয়ে রাখা নির্যাতনের গল্পগুলিও আমাদের মিল। মেয়ে -ইশকুলে আমরা কেউ প্রিয়সখীকে বিপন্ন বিস্ময়ে পুরতে পুরতে এসব গল্প করে ফেলছি, কেউ চুপচাপ মুখ চুন করে ক্লাসের আরামে বসে আছি, কেউ টয়লেটে গিয়ে কাঁটা কম্পাস দিয়ে খোঁচাচ্ছি হাত। আমরা জানতাম এরা মামা-চাচা-ফুপা-খালু-দুলাভাই-নানু-দাদু অনেককিছু, এরা এইসব মেয়ে শিশুদের (মানে আমাদের) একান্ত স্বজন। এরা আমাদের সাফল্যে উজ্জ্বল হাসে, এরা আমাদের বিয়ের সময় সমবেদনার আর শুভানুধ্যায়িতার আঢ্য হয়, এদের অভিভাবকত্বেই মেয়ে শিশুরা লালিত পালিত অভ্যর্থিত আপ্যায়িত হয় । কিংবা জানতাম এরা শুধুই পুরুষ। জীবজগতে আর কোন পুংলিঙ্গধারী প্রাণী এত বুদ্ধি আর এত মর্মান্তিক হৃদয়হীনতা একত্রে একই করোটিতে পুষতে পারে কি না সন্দেহ। এদের অপরাধকে কেউ অপরাধ ডাকতো না, অপরাধীর র্দ হতো না কখনো, বাদীপক্ষ নিশ্চুপ থাকতো কিংবা আওয়াজ করলেও তাদের থামিয়ে দেয়া হতো। এভাবেই আমাদের বড় হবার অবশ্যপাঠ্য অধ্যায় রচিত হচ্ছিল। সবার আরালে। নিঃশব্দে। প্রত্যেকে একটি অদৃশ্য নোটবুকে অমোচনীয় কালিতে লিখে নিচ্ছি— ১. যে আমার জন্য বাজার ঘুরে মনোহারী সামগ্রী কিনে আনে তার কাছে আমার শরীর নিরাপদ নয়। ২. যে আমাকে ছোটবেলায় বাতাসে ছুঁয়ে দিয়ে লুফে নিত, তার কাছে আমার শরীর নিরাপদ নয়। এইভাবে আরো অনেক সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণে ঠাসা হয়ে যেত সেই অদৃশ্য নোটবুক। এভাবেই আমরা বড় হয়েছিলাম। বড় হয়েছি। আমাদের আশপাশে যা কিছু ধূসর এবং দূরায়ত ছিল, তা ঘনিয়ে ওঠা কালো রঙ হয়েছে। যা ভাল ছিল তা পেন্সিলের রেখার মতো ফিকে হয়ে গেছে, যা অশুভ ছিল তার মোচ্ছব চলছে। আচ্ছা, পার্বতীপুরের শিশু পূজাকে তার কথিত ‘বড় আব্বা’ ব্লেড দিয়ে কেটে কেটে যোনিপথ বড় করে ধর্ষণ করেছিল, সেই শিশুটিকে আমরা এই দেড় বছরে ভুলে গেছি, তাই না? গ্নেডাারিয়ার দীননাথ সেন রোডের যে দুই বছরের শিশুকে খিচুড়ি খাওয়ানোর প্রলোভন দেখিয়ে এনে ধর্ষণ করে তিনতলা থেকে ছুঁড়ে হত্যা করেছে নাহিদ, তাকেও তো ভুলে যাব, তাই না? আরো যোগ হয়েছে ওয়ারীর শিশু সায়মার নাম, ঘন্টাখানেক নজরদারিতে ছিল না যে শিশু, তাকেও ভুলতে আমাদের তেমন সময় লাগবে না, তাই না? পরিসংখ্যানের কথা এখানে বলবো না, আমার হাত কাঁপে, আমার প্রাণ কাঁপে। হাজার হাজার শিশু ধর্ষিত হচ্ছে, ধর্ষণের পর খুন হচ্ছে আমাদের দেশে, কাছের মানুষরাই নিয়ে যাচ্ছে তাদের ডেকে। আত্মীয়স্বজন নিরাপদ নয়, স্কুল নিরাপদ নয়, খেলার আঙিনা নিরাপদ নয়, মাদ্রাসায় ধর্ষণের খবর আসছে প্রায় প্রতিদিন। পিডোফিলদের হাত থেকে শিশুদের বাঁচাবার জন্য আমরা কিছুই করতে পারিনি। শিশু যখন ফ্যালফ্যাল করে বসে থাকে, কেবল কাঁদে কিন্তু কিছু বলে না, কেবল দুঃস্বপ্ন দ্যাখে, কেবল কাউকে দেখে ভয়ে সিঁটিয়ে যায়, কেবল ড্রয়িং খাতায় বীভৎস ছবি আঁকে তখন আমরা তাকে বিশ্বাস করে তার কথা শুনতে চাই কি? সে যে আমাদের পছন্দসই প্রিয়জনদের পছন্দ করতে, কাছে যেতে, চুমু খেতে, জড়িয়ে ধরতে বাধ্য নয়, তা মনে রাখি কি? যখন শিশু বিশ্বাস করে চেষ্টা করে তার নির্যাতনের ইতিহাস ব্যক্ত করে (বিশ্বাস করুন, শরীরের অঙ্গগুলির নাম নেয়াটাও তার জন্য দুরূহ, সে স্বভাব-লাজুক), আমরা তার নির্যাতকের শাস্তির ব্যবস্থা দূরে থাক, তাকে চিহ্নিতও করি কি? মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা বা প্রতিরক্ষা বা পরীক্ষা করে আমরা শিশুদের কাছে একজন পরিণতবয়স্ক মানুষকে পাঠাই কি? শিশু-সংস্রব থাকে যেসব পেশায় সেই পেশায় শিশু নির্যাতক যেন কিছুতেই অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেই ব্যবস্থাই তো আমরা করতে পারিনি। একটি রাষ্ট্রের প্রশাসনের এর চেয়ে বড় পরাজয় আর কিছুতেই হতে পারে না। যুক্তরাজ্যে শিশু ধর্ষণ এবং শিশুহত্যার ইতিহাসে একটি ভয়াাবহ নাম ‘মোরস মার্ডারার্স’। ষাটের দশকে প্রেমিক-প্রেমিকার এই জুটি ফুসলে শিশুদের সংগ্রহ করে এনে ধর্ষণ করে স্যাডল ওয়ার্থ মোরের কোন এক প্রান্তরে পুঁতে দিয়ে আসতো, কখনো সেই কবরের ওপর গিয়ে বনভোজন করতো। মোরস মার্ডারার্সদের পুরুষটির নাম ইয়াান ব্রেডি, যে সমাজে যৌন অবদমন ধর্ষণের কারণ নয় সেই খোলামেলা সমাজেরই বাসিন্দা। সে বলেছিল — শিশুকে ধর্ষণ করার সময় এবং প্রাণনাশের সময় শিশুর যুঝবার ক্ষমতার বিপরীতে পূর্ণবয়স্ক মানুষের যে অসম্ভব ক্ষমতা সে উপভোগ করতো, তাই তাকে বারবার এ কাজ করতে উৎসাহী করতো। এই অসম্ভব ক্ষমতার মুহূর্ত উপভোগ করার তৃষ্ণা কোথা থেকে আসতো? কোথা থেকে আসে? সমাজে যখন মানুষ আপন বিদ্যা-বুদ্ধি-পারদর্শিতার জোরে তেমন কিছু করতে পারে না, তখনকার নৈরাশ্য থেকে? যখন সমাজ হিতাহিতের আদর্শ তুলে ধরতে হয়, তখন? যখন রাষ্ট্র ভয়ানক সব অপরাধের তাৎক্ষণিক সাজা দিতে ক্রমাগত ব্যর্থ হয়, তখন? শিশু যদি অবর্ণনীয় ঘৃণা আর শাস্তির মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে, তখন? মনোবিজ্ঞানীরা ভাল বলতে পারবেন। ‘মোরস মার্ডারার্স’জুটির নারীটির নাম ময়রা হিন্ডলি। তার জীবনী লেখা হয়েছে, সেই জীবনীগ্রন্থের নাম ‘আমি তোমাদেরই লোক’, এই নামটার ভেতর রয়ে গেছে আমাদের ছোটবেলার সেই অদৃশ্য নোটবুকের প্রথম কথাটাই — শিশুধর্ষকরা আমাদের ভেতরেই আছে, ঘরে এবং আঙিনায়, অদূরে। মেয়েশিশু তো বটেই, ছেলেশিশুরাও তাদের হাতে কখনোই নিরাপদ ছিল না। শেষ করবো একটি কথা বলে।
যে শিশুটি ধর্ষিত হচ্ছে, সে পথশিশুই হোক, কি ঘরের, কি আবাসিক মাদ্রাসার, সেই শিশুটি বেঁচে থাকলে একটি অলিখিত নোটবুক হাতেই চুপচাপ বড় হয়ে উঠবে তা ভাববেন না যেন। শৈশবে যে এমন নির্যাতনের শিকার হয়, অনেকক্ষেত্রেই সে বড় হয়ে নির্যাতক হয়, খুনি হয়, সিরিয়াল কিলার হয়। নির্যাতক হয়ে সে নিজের প্রতি নির্যাতনের জ্বালা ভুলতে চায়। অর্থাৎ আমরা আজ যা দেখছি চারপাশে, তাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবেন না প্লিজ, তাহলে আরো অনেক ভয়াবহ দিন আসবে সামনে। আওয়াজ ওঠাই চলুন। বারবার। অক্লান্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published.