জানুয়ারিতেই ফাইভজি নীতিমালা, ‘ প্রতারণা’ বলছে গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন

জয়দুল হাসান॥ বাংলাদেশে পঞ্চম প্রজন্মের (ফাইভজি) মোবাইল ফোন সেবা চালুর সিদ্ধান্তনিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) মো. জাকির হোসেন খাঁন বলেন, মঙ্গলবার এ সংক্রান্ত গঠিত কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই কমিটি ফাইভজি প্রযুক্তি প্রবর্তনের লক্ষ্যে আগামী বছরের জানুয়ারি নাগাদ একটি পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাবনা এবং পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রণয়ন করবে। 5g
বিটিআরসি বলছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের দিক নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখিত সময়ের আগেই ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সহায়তায় ফাইভজি সেবা চালু করা সম্ভব হবে।
তবে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, বর্তমান সময়ে টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা ও কোয়ালিটি অব সার্ভিস এতটাই খারাপ যে ফোরজির জায়গায় থ্রিজি পাওয়া দুষ্কর। এমতাবস্থায় বিটিআরসি ও সরকারের ফাইভজি চালুর সিদ্ধান্ত গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই না।
বিটিআরসি সূত্রে জানা গেছে, ফাইভজি সেবা চালু করতে পরিকল্পনা ও একটি নীতিমালা প্রণয়নে সরকারের প্রতিনিধি, নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রতিনিধি, অপারেটরগুলোর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে কমিশন গত ৪ অগাস্ট একটি কমিটি গঠন করে। কমিটি বাংলাদেশে এই প্রযুক্তি চালু করতে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাবনা (ফাইভজির রূপরেখা, সম্ভাব্য তরঙ্গ, তরঙ্গমূল্য এবং বাস্তবায়ন সময়কাল ইত্যাদি) প্রণয়ন করবে। সেইসঙ্গে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালও তৈরি করবে।
এ কমিটি আগামী বছরের জানুয়ারি নাগাদ ফাইভজি সংক্রান্ত একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রণয়ন করবে বলে সিদ্ধান্ত হয় মঙ্গলবারের বৈঠকে।
বিটিআরসি বলছে, দক্ষিণ কোরিয়া, আয়ারল্যান্ড, স্পেন, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই প্রযুক্তিতে প্রবেশ করেছে। প্রতিটি দেশেই অপারেটরকে ৩৩০০ ৪২০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডে প্রায় ১০০ মেগাহার্টজ এবং মিলিমিটার ওয়েভের জন্য ২৬ ২৮ গিগাহার্টজ বা তদূর্ধ্ব ব্যান্ডে ৮০০ মেগাহার্টজ তরঙ্গ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে কিছু কিছু দেশ ২.৫ গিগাহার্টজ (২৫০০-২৬৯০ মেগাহার্টজ) ব্যান্ডে ফাইভজির জন্য তরঙ্গ বরাদ্দ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।
বিটিআরসি জানায়, ২৮ গিগাহার্টজ ব্যান্ডে ফাইভ জি সেবার ওপর একটি উপস্থাপনা প্রদর্শন করা হয়েছে। বর্তমানে ২.৬ গিগাহার্টজ, ৩.৫ গিগাহার্টজ ইত্যাদি ফাইভজি সেবার জন্য জনপ্রিয় ব্যান্ড হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার-২০১৮ অনুযায়ী ২০২১ ২৩ সালের মধ্যে দেশে ফাইভজি সেবা চালুর প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
ফাইভজি সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে ২.৬ গিগাহার্জ, ৩.৫ গিগাহার্জ ব্যান্ডের সঙ্গে অন্যান্য ব্যান্ডের বিষয়ে ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠেয় ওয়ার্ল্ড রেডিও কনফারেন্সে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) মাধ্যমে ২৫০০-২৬৯০ মেগাহার্টজ, ৩৩০০-৪২০০ মেগাহার্টজ, ২৬-২৮ গিগাহার্জ, ৩২ গিগাহার্জ, ৩৮ গিগাহার্জ, ৪০ গিগাহার্জ এবং ৪৩ গিগাহার্জ ব্যান্ডগুলো ফাইভজি প্রযুক্তির জন্য তরঙ্গ বরাদ্দ দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
উন্নত দেশে ফাইভজি প্রযুক্তি চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো প্রস্তুতি থাকায় তারা এই প্রযুক্তি চালু করার ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সমসাময়িক সময়ে ফাইভজি প্রযুক্তি প্রবর্তনে কমিশন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
স্বল্প খরচে মোবাইল কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক স্থাপনের অন্যতম প্রধান শর্ত হলো একই তরঙ্গ ব্যাপক ভিত্তিতে ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত করা। আইটিইউ বিশ্বব্যাপী এই ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ফাইভজির জন্য তরঙ্গ বরাদ্দ দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এছাড়া মিলিমিটার ওয়েভের জন্য প্রস্তাবিত ব্যান্ডগুলো বরাদ্দ দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে তরঙ্গ আছে বলে জানিয়েছে বিটিআরসি।
তবে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন বলছে ভিন্ন কথা। মঙ্গলবার যুগান্তরের কাছে পাঠানো এক বিবৃতিতে অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিটিআরসি ফাইভজি চালুর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। এ খবরে সবচেয়ে খুশি হবার কথা আমাদের। কিন্তু খুশি না হয়ে এ ধরণের সিদ্ধান্তে আমরা আতঙ্কিত হচ্ছি। কারণ ফোরজি চালুর সময় টেলিযোগাযোগের যে অবস্থা ছিল বর্তমানে তা নেই।
তিনি বলেন, ফোরজি চালুর ১৭ মাস পার হলেও সারাদেশে এখন পর্যন্ত ফোরজি দূরে থাক থ্রিজিও নিশ্চিত করা যায়নি। সেই সঙ্গে বর্তমানে যোগ হয়েছে ৬৪ ভাগ মার্কেট দখলকারী গ্রামীণফোন ও রবির বিরুদ্ধে পাওনা নিয়ে ঝামেলা। বিটিআরসি তাদের ব্যান্ডউইথ ও এনওসি বন্ধ করার ফলে গ্রাহকরা কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে এমনিতেই বঞ্চিত। বর্তমান সময়ে কোয়ালিটি অব সার্ভিস যদি মাপা হয় তাহলে দেখা যাবে যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক নিম্নমানের।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা একদিকে পাওনা আদায়ের জন্য অপারেটর দুটি লাইসেন্স বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। আবার অন্যদিকে ফাইভজি চালুর সিদ্ধান্ত নিতে যাচে। বিষয়টি এমন যে, যে ডালে বসে আছেন সে ডালই আপনি কাটছেন। নিয়ম অনুযায়ী এনওসি বন্ধের ফলে তাদের আর নতুন করে স্পেকট্রাম ক্রয় করতে পারবে না।
মহিউদ্দিন আহমেদ অভিযোগ করে বলেন, রাষ্ট্রীয় অপারেটর টেলিটক এখনও ফোরজি চালু করতে পারেনি। গ্রাহকদের ৯০ শতাংশ এখনও ফোরজি সেবা গ্রহণ করেননি। ফাইভজির ডিভাইস দেশে পর্যাপ্ত নয়, তাও আবার অতি উচ্চ মূল্যে। নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। অপারেটরদের এখন পর্যন্ত স্পেকট্রাম আছে ৩৫ মেগাহার্টজ। অথচ ফাইভজিতে লাগবে প্রায় ১০০ মেগাহার্টজ।
এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় স্ট্রেক হোল্ডার গ্রাহকদের সঙ্গে সরকার বা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আলোচনা করে নাই। এমতাবস্থায় যদি ফাইভজি চালু করা হয় তা হবে শুধু কাগজে কলমে। এটি একদিকে যেমন হাস্যকর অন্যদিকে গ্রাহকদের কাছে প্রতারণা ছাড়া কিছুই না। বলে মন্তব্য করেন মহিউদ্দিন আহমেদ।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে ১৯৯০ সালে টুজি প্রযুক্তির মোবাইল ফোন সেবা চালু হয়। এর পর ২০১৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই আসে থ্রিজি। এরপর ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে চালু হয় ফোরজি সেবা। এদিকে নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী ২০২১ ২৩ সালের আগেই দেশে ফাইভজি সেবা দিতে চায় সরকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published.