দুর্বল আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে একীভূত করার উদ্যোগ

শান্তি ডেক্স ॥ খেলাপি ঋণ কমিয়ে দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনায় ব্যর্থ হলে দুর্বল ও অদক্ষ ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে’ একীভূত বা অবসায়ন করা হবে। এর আগে কেন এবং কোথায় প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যর্থ হচ্ছে তা দ্রুত বের করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে কেন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ দিতে পারছে না- এর কারণও খতিয়ে দেখতে বলা হয়। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠানের’ চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) বৈঠকে এ বিষয়গুলোসহ আরও কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সিদ্ধান্তগুলো অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে জানানো হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, লিজিং কোম্পানিগুলোর একই অভিযোগ, তাদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে গ্রহীতারা সময়মতো ফেরত দিচ্ছেন না। ঋণ আদায়ে পদক্ষেপ নিলে গ্রহীতারা উচ্চ আদালতে মামলা করছেন। ফলে টাকা আদায় সম্ভব হচ্ছে না। এসব সমস্যা দূর করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিদ্যমান আইনে কিছু বিচ্যুতি আছে। এসব দূর করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সূত্র মতে, অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকের ‘রেকর্ড অব নোটস’ তৈরি করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। সেখানে এসব বিষয় উঠে এসেছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেয়া অন্য সব নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে- এখন থেকে জামানত গ্রহণ নিশ্চিত করে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরই ঋণ দিতে হবে, নতুন ঋণ দেয়া যাবে না। এছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ড ইস্যুর পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি উচ্চ সুদ হার কমাতে হবে। নির্দেশনায় ঋণখেলাপিদের প্রসঙ্গে বলা হয়, বর্তমানে দেশে ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি আছে। এদের মধ্যে যারা টাকা পরিশোধ করতে ইচ্ছুক তাদের এক্সিট ও পুনঃতফসিল সুবিধা দিতে হবে। পাশাপাশি যারা অসাধু তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। বৈঠকের ‘রেকর্ড অব নোটসে’ অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য তুলে ধরা হয়। অর্থমন্ত্রী ওই বৈঠকে বলেছেন, অর্থনীতি এগিয়ে নিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান অনেক। কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো স্বল্প মেয়াদে আমানত গ্রহণ করে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করছে। ফলে একটি অসঙ্গতি দেখা দিয়েছে। বৈঠকে তিনি উচ্চ সুদ হার নিয়ে অসস্তোষ প্রকাশ করে বলেন, এমন উচ্চ সুদ হার পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নেই। জানা গেছে, দেশে মোট ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান (লিজিং কোম্পানি) রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্সপ্রাপ্ত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন হচ্ছে ৩টি। ওই বৈঠকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো: আসাদুল ইসলাম।সেখানে বলা হয়, সম্প্রতি পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এই কোম্পানি অবসায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া দেশে কর্মরত লিজিং কোম্পানিগুলোর গ্রাহক মেয়াদি আমানতের টাকা যথাসময়ে ফেরত না দিয়ে হয়রানি করছে। এ ধরনের বিভিন্ন অভিযোগ মিডিয়ার মাধ্যমে নানাভাবে আলোচিত হচ্ছে। ভুক্তভোগী গ্রাহকরা টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য জনপ্রতিনিধিসহ সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার কাছে আবেদন ও অভিযোগ করছেন। এ পরিস্থিতিতে গ্রাহকদের সুদসহ টাকা ফেরত দেয়ার বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া আবশ্যক হয়ে পড়েছে। বৈঠকের ‘রেকর্ড অব নোটসে’ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, বর্তমানে ৩টি লিজিং কোম্পানির অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে পিপলস লিজিং অবসায়ন করা হয়েছে। অন্য দুটির অবস্থা উন্নতি না হলে একই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি আরও বলেন, এসব সমস্যাগ্রস্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান মজবুত করার ক্ষেত্রে এটিকে একটি সতর্কবাণী হিসেবে গণ্য করতে হবে। অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদার লিজিং কোম্পানি প্রসঙ্গে বলেন, আমানতের সুদ ৬ শতাংশ ও ঋণের সুদ ৯ শতাংশ করার বিষয়ে অনেক আগের সিদ্ধান্ত হলেও তা এখনও সর্বক্ষেত্রে কার্যকর হয়নি। এক্ষেত্রে সুদ হার ৯ শতাংশ কার্যকর করতে ঋণ ব্যয় কমাতে হবে। অধিক সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহ করা যাবে না। কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানত অধিক সুদহার দিয়ে রাখা যাবে না। যদি কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান অধিক সুদহার চায় সেক্ষেত্রে বিষয়টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে জানাতে নির্দেশ দেয়া হয়। রেকর্ড অব নোটসে ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান বলেন, আর্থিক খাত বর্তমানে ক্যান্সারে আক্রান্ত। ইনসাইডার লেনডিংয়ের কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে। প্রিমিয়ার লিজিংয়ের চেয়ারম্যান এজেডএম আকরামুল হক বলেন, ‘অ ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তারল্য সংকটে ভুগছে। এর মূল কারণ খেলাপি ঋণের আধিক্য এবং বহিরাগত প্রেসার গ্রুপ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিয়মবহির্ভূত কাজ করা।’ বিআইএফএফএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ এখলাসুর রহমান বলেন, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক তাদের প্রতিষ্ঠানে রক্ষিত আমানতগুলো ঋণ হিসেবে নিয়ে চলে গেছেন। এর ফলে উচ্চমাত্রার খেলাপি ঋণের সৃষ্টি হয়েছে। এসব মালিকের বিরুদ্ধে বিশ্বাসভঙ্গের দায়ে অবিলম্বে ফৌজদারি মামলা করার পরামর্শ দেন তিনি।
প্রসঙ্গত বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবেই এ খাতের ১২টি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। এর মধ্যে ৬টি প্রতিষ্ঠান নামেই বেঁচে আছে। কোনো প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণ ৯৬ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। গ্রাহকের কাছে এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের সর্বশেষ স্থিতি ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এর বেশির ভাগ বিতরণ করা হয়েছে আবাসন খাতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.