কারিগরি টেকনোলজিস্টরা নার্স হয় কী করে?

প্রশান্তি ডেক্স॥ বৃহত্তর আন্দোলনে নামার পরিকল্পনা করছেন সাধারণ নার্সরা! কারিগরি বোর্ডের পেশেন্ট কেয়ার টেকনোলজিস্টদের ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কোর্সের নিবন্ধন দেয়া হলে সাধারণ নার্সসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠন আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবেন বলে আভাস দিয়েছেন। তারা বলছেন, কারিগরি বোর্ডের পেশেন্ট কেয়ার টেকনোলজিস্টদের ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কোর্সের নিবন্ধনের অপচেষ্টা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা ধ্বংসের নীলনকশা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের রুলস অব বিজনেস এলোকেশন অনুসরণ না করে এবং বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের (বিএনএমসি) আইন-বিধান ভঙ্গ করে ভিন্ন কোর্স, ভিন্ন নাম, ভিন্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা, ভিন্ন কারিকুলাম, ভিন্ন বিভাগ, ভিন্ন নীতিমালা সত্ত্বেও কারিগরি বোর্ডের পেশেন্ট কেয়ার টেকনোলজিস্টদের ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কোর্সের নিবন্ধন দেয়ার অপচেষ্টা চলছে। কারিগরি বোর্ড থেকে পাস করা টেকনোলজিস্টরা নার্স হয় কী করে এ নিয়ে তারা প্রশ্ন রাখেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক নার্স নেতা বলছেন, নার্সিং সেক্টরকে ঘিরে সুগভীর ষড়যন্ত্র চলছে। খোদ নার্সিং সেক্টরের একটি অপচক্র বিপুল উৎকোচের বিনিময়ে কারিগরি বোর্ডের তথাকথিত পেশেন্ট কেয়ার টেকনোলজিস্টদের ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কোর্সকে অন্তর্ভুক্ত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন বলে তারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
জানা গেছে, ইতোমধ্যেই হাইকোর্ট থেকে কারিগরি বোর্ডের ওই কোর্সের নিবন্ধনের জন্য আদেশ হয়েছে। এ আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হয়েছে। খুব শিগগিরই এ নিয়ে শুনানির কথা রয়েছে। সম্প্রতি লাইসেন্সিং পরীক্ষা বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির উদ্যোগে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। সংগঠনের সভাপতি আবিদা সুলতানার সভাপতিত্বে কর্মসূচিতে বাংলাদেশ নার্স টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন (বিএনএ), বাংলাদেশ ইন্টার্ন নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ বেসিক গ্র্যাজুয়েট নার্সেস সোসাইটি, বাংলাদেশ ডিপ্লোমা স্টুডেন্ট নার্সেস ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
তারা বলেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি স্বতন্ত্র পেশা হিসেবে বেঙ্গল নার্সিং কাউন্সিল অ্যাক্ট-১৯৩৪, পরবর্তীতে পাকিস্তান নার্সিং কাউন্সিল অ্যাক্ট-১৯৫২, বাংলাদেশ নার্সিং কাউন্সিল অর্ডিন্যান্স-১৯৮৩ এবং বর্তমানে বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিল আইন-২০১৬ দ্বারা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে মেডিকেল শিক্ষার ন্যায় নার্সিংশিক্ষা পরিচালিত হওয়ায় কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কখনোই কোনোরূপ স্বাস্থ্যশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার বৈধ কর্তৃপক্ষ হতে পারে না।
তারা আরও বলেন, বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিল ডিপ্লোমা স্টুডেন্ট ভর্তির ক্ষেত্রে এইচএসসি ব্যাকগ্রাউন্ড, জিপিএ, বয়স, সেশন, জেলা কোটা ও পুরুষ-নারী কোটা বিবেচনা করলেও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ক্ষেত্রের কোনোটাই মানা হয় না।
এছাড়া বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের ক্ষেত্রে মেডিকেল স্টুডেন্টদের ন্যায় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নার্সিং স্টুডেন্ট ভর্তির ব্যবস্থা থাকলেও বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ক্ষেত্রে তা নেই। বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের অধিভুক্ত সকল প্রতিষ্ঠান নার্সিং শিক্ষকমন্ডলী দ্বারা পরিচালিত এবং শিক্ষার্থীদের প্রথম বর্ষ থেকেই হাসপাতালে ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিস (ব্যবহারিক শিক্ষা) বাধ্যতামূলক হলেও বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ক্ষেত্রে তা নেই।
কাউন্সিল কর্তৃক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট মেডিকেল ও নার্সিং বিশেষজ্ঞসহ স্টেকহোল্ডার সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে আন্তর্জাতিক মানের নার্সিং কারিকুলামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অর্থাৎ প্রার্থীর ভর্তি যোগ্যতা, কোর্সের শিরোনাম, বিষয়সমূহ, ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিক পাঠদানের সময়সূচি বণ্টন, কোর্সের মেয়াদ ও পূর্ণমান, পাস নম্বর ইত্যাদি নির্ধারণ করা হলেও কারিগরি বোর্ডের ক্ষেত্রে এসব কিছুই অনুসরণ করা হয়নি। এমনকি কোনো মেডিকেল বিশেষজ্ঞ বা নার্সিং বিশেষজ্ঞ দ্বারা কোর্স কারিকুলাম প্রণয়ন বা পরিচালনা করা হয় না।
মেডিকেল বা নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেমন প্রকৌশলী বা স্থপতিদের শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করা যায় না তেমনি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও চিকিৎসাশিক্ষা বা নার্সিংশিক্ষা পরিচালনার কোনো সুযোগ নেই।
কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পেশেন্ট কেয়ার টেকনোলজিস্টদের ডিপ্মো ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কোর্সের নিবন্ধন দাবি করায় সৃষ্ট জটিলতার কারণে ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি, ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারি, বেসিক বিএসসি ইন নার্সিং কোর্স সম্পন্নকারী আট হাজারেরও অধিক শিক্ষার্থীর কম্প্রেহেনসিভ/লাইসেন্সিং পরীক্ষা দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকায় অপেক্ষমাণ পরীক্ষার্থী ও বিভিন্ন কোর্সে অধ্যয়নরত স্টুডেন্ট নার্সরা হতাশা, ক্ষোভ ও তীব্র প্রতিবাদ জানান।
বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা বলেন, সেবার গুণগত মান নিশ্চিত করা নার্সিং পেশার মূল লক্ষ্য। শুধু মানবিক দিক বিবেচনায় ভিন্ন কোর্স, ভিন্ন নাম, ভিন্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা, ভিন্ন কারিকুলাম, ভিন্ন বিভাগ, ভিন্ন নীতিমালা, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের অনুমোদনহীন বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে পাসকৃতদের ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কোর্সের নিবন্ধন প্রদান করা হলে মূল লক্ষ্য অর্জন বিশেষভাবে বাধাগ্রস্ত হবে, নার্সিং শিক্ষা নীতিমালা বাস্তবায়নে প্রকট সংকট সৃষ্টি হবে, সেবাগ্রহণে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হবে, হাসপাতালে সেবার মান ধ্বংস হবে ও বহির্বিশ্বে নার্সদের মানমর্যাদা প্রশ্নবিদ্ধ হবে, নার্সিংশিক্ষা সার্ভিস ও প্রশাসনের সকল ক্ষেত্রে নানাবিধ জটিলতার সৃষ্টি হবে এবং উন্নয়নমুখী এ পেশাটি হবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত।
তাই জরুরি ভিত্তিতে এ বিষয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনপূর্বক নিবন্ধন প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণে নার্সবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা।
বাংলাদেশ নার্সিং কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার সুরাইয়া বেগম বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কিছুতেই নার্সিং কোর্স চালু করতে পারে না। নার্সিংয়ের বিভিন্ন কোর্সে নীতিমালা অনুযায়ী (শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ অন্যান্য ক্রাইটেরিয়া ফিলআপ করে) ভর্তি পরীক্ষায় পাস করে নির্দিষ্ট মেয়াদে কোর্স সম্পন্ন ও পরীক্ষা দিয়ে তবেই সার্টিফিকেট পান নার্সরা। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে এসবের বালাই নেই। এ কোর্স অন্তর্ভুক্ত হলে স্বাস্থ্যসেবার মারাত্মক অবনতি ঘটার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
তিনি জানান, স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ অন্যান্যারা এ বিষয়ে অবগত এবং প্রধানমন্ত্রীকে এ ব্যাপারে জানানো হবে।
স্বাধীনতা নার্সেস পরিষদ (স্বানাপ) মহাসচিব ইকবাল হোসেন সবুজের কাছে এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কারিগরি বোর্ডের পেশেন্ট কেয়ার টেকনোলজিস্টদের ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কোর্সের নিবন্ধনের অপচেষ্টা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা ধ্বংসের নীলনকশা। কারিগরি বোর্ডের কোর্সকে স্বাস্থ্য সেক্টরে অন্তর্ভুক্ত করা হলে স্বাস্থ্যসেবার মান নিম্নমুখী হবে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নার্সিং সমাজ কিছুতেই মেনে নেবে না।এক্ষেত্রে তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সময়োচিত হস্তক্ষেপ দাবি করে বলেন, প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধভাবে বৃহত্তর আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবেন নার্সরা।বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন (বিএনএ), ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল শাখার সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান জুয়েল বলেন, জনগণের স্বাস্থ্যসেবা সুরক্ষা এবং উন্নয়নমুখী নার্সিং পেশার মানরক্ষায় কারিগরি বোর্ড থেকে পাস করা পেশেন্ট কেয়ার টেকনোলজিস্টদের কোনোক্রমেই নার্স হিসেবে নিবন্ধন দেয়া যাবে না। নিবন্ধন দেয়া হলে কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করতে বাধ্য হব আমরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published.