প্রশান্তি ডেক্স ॥ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও দেশের পুঁজিবাজারের গতি ফিরছে না। দিন যত যাচ্ছে পুঁজিবাজার তত তলানিতে নিমজ্জিত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত বিনিয়োগ করা পুঁজি হারাচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। ফলে পুঁজি হারানো বিনিয়োগকারীদের হাহাকার বেড়েই চলছে। পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুঁজিবাজারের গতি ফেরাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হলেও বাস্ততসম্মত ও যুগোপযোগী কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। ‘টোটকা’ পদক্ষেপ নিয়ে পুঁজিবাজারে গতি ফেরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। যে কারণে ফল পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের মতে, পুঁজিবাজারে গতি ফেরাতে হলে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ জন্য দেশি-বিদেশি ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে। পুঁজিবাজার কারসাজিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। সেই সঙ্গে ব্যাংক খাতের সমস্যার সমাধানও করতে হবে। তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর পুঁজিবাজারের জন্য চলতি বছরের শুরুটা ছিল বেশ ইতিবাচক। ভোটের পর প্রায় এক মাস ঊর্ধ্বমুখী থাকে বাজার। তালিকাভুক্ত প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের দাম বাড়ে। এতে এক মাসের মধ্যে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্য সূচক ৭০০ পয়েন্টের ওপরে বেড়ে যায়। লেনদেন পৌঁছে যায় হাজার কোটি টাকায়। তবে ফেব্রুয়ারিতে এসে পথ হারিয়ে বসে পুঁজিবাজার। ঊর্ধ্বমুখী বাজারে নেমে আসা পতনের ধারা। এরপর এক এক করে আরও সাতটি মাস চলে গেলেও পতনের কবল থেকে উঠতে পারেনি দেশের পুঁজিবাজার। বরং সময় যত গড়িয়েছে বাজারে পতনের প্রবণতা তত বেড়েছে। সেই সঙ্গে তারল্য সংকটে দেখা দিয়েছে লেনদেন খরা। ফলে হাজার কোটি টাকায় পৌঁছে যাওয়া ডিএসইর লেনদেন এখন ৩০০ কোটি টাকার ঘরে ঘুরপাক খাচ্ছে। পুঁজিবাজারকে এমন দৈন্যদশা থেকে বের করে আনতে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একাধিক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর)। রেপোর (পুনঃক্রয় চুক্তি) মাধ্যমে অর্থ সরবরাহের সুযোগও দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে একটি ব্যাংক এ সুবিধা গ্রহণও করেছে। এছাড়া পুঁজিবাজারে তারল্য বাড়াতে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। বন্ড বিক্রি করে সোনালী ব্যাংক থেকে পাওয়া ২০০ কোটি টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করছে প্রতিষ্ঠানটি। এর পাশাপাশি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকারি ৫টি প্রতিষ্ঠানের কাছে ২ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে আইসিবি। এ টাকা পেলে তার পুরোটা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা হবে। এছাড়া ইউনিট ফান্ডের মাধ্যমে আইসিবিকে তহবিল সংগ্রহের সুযোগ দিতে চাচ্ছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। গতি ফেরাতে এ ধরনের একের পর এক পদক্ষেপ নেয়া হলেও পুঁজিবাজার তলানিতেই রয়ে গেছে। অব্যাহত পতনের কবলে পড়ে গত ১৩ অক্টোবর ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে চলে আসে। এরপর আইসিবির বিনিয়োগ বাড়ানোর ফলে ১৫ অক্টোবর পুঁজিবাজারে বড় উত্থান হয়। এতে পুঁজি হারানো বিনয়োগকারীরা আবার আশার আলো খুঁজতে থাকেন। কিন্তু পরের কার্যদিবসেই তাদের সেই আশার আলো নিভে যায়। বড় উত্থানের পর দেখতে হয় বড় দরপতন। সেই পতনের ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ সোমবার (২১ অক্টোবর) ডিএসইতে লেনদেনে অংশ নেয়া বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দরপতন হয়েছে। এতে কমেছে সবকটি মূল্য সূচক। এর মাধ্যমে শেষ ১১ কার্যদিবসের মধ্যে ৯ কার্যদিবসেই পতনের ঘটনা ঘটল। বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার পরও পুঁজিবাজারে পতনের ধারা অব্যাহত থাকার কারণ হিসেবে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, বাজারের জন্য টোটকা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এ ধরনের টোটকা ওষুধে কাজ হবে না। পুঁজিবাজার ভালো করতে হলে দেশি-বিদেশি ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত করতে হবে। সেই সঙ্গে কারসাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে ব্যাংক খাতের যে সমস্যা রয়েছে তারও সমাধান করতে হবে। পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মুসা বলেন, এ মুহূর্তে পুঁজিবাজারের সব থেকে বড় সমস্যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা সঙ্কট। বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের কোনো আস্থা নেই। বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারবিমুখ হয়ে গেছেন। ফলে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হলেও বাজারে তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। ডিএসইর এক সদস্য বলেন, পুঁজিবাজারের সব থেকে বড় সমস্যা আস্থা ও তারল্য সঙ্কট। পুঁজিবাজারের জন্য সম্প্রতি যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তাতে বাজারে তারল্য খুব একটা বাড়বে না। রেপোর মাধ্যমে তারল্য সরবরাহের যে সুযোগ দেয়া হয়েছে, কয়টি ব্যাংক সে সুবিধা নিয়েছে। আইসিবি বিনিয়োগ করলে, তার পরিমাণ খুব বেশি না। আবার ব্রোকারেজ হাউজগুলোতেও টাকা নেই। এ বাজারে দ্রুত তারল্য সরবরাহের উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে বাজারের মন্দা অবস্থা কাটানো কঠিন হবে।
বাজার চিত্র
গত সোমবার (২১ অক্টোবর) লেনদেনের শুরুতে কিছুটা ঊর্ধ্বমুখিতার আভাস দেখা দিলেও লেনদেনের শেষ দুই ঘণ্টায় অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের দরপতন হয়েছে। ফলে এ দিন ডিএসইতে লেনদেনে অংশ নেয়া মাত্র ৬৩টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ২৫০টির। ৪১টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের দরপতনের কারণে ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স ২০ পয়েন্ট কমে ৪ হাজার ৭৬১ পয়েন্টে নেমে গেছে। অপর দুই সূচকের মধ্যে ডিএসই শরিয়াহ্ ৯ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৮৯ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। ডিএসই-৩০ সূচক ১০ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৬৭৫ পয়েন্টে অবস্থান করছে। দিনভর বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ৩৫০ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয় ৩১২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ লেনদেন খরা অব্যাহত থাকলেও আগের কার্যদিবসের তুলনায় ৩৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা লেনদেন বেড়েছে।লেনদেন খরার বাজারে টাকার অঙ্কে সব থেকে বেশি লেনদেন হয়েছে ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশনের শেয়ার। কোম্পানিটির ১২ কোটি ৮১ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ন্যাশনাল টিউবসের ১১ কোটি ৯৭ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। ১০ কোটি ৯৯ লাখ টাকার লেনদেনের মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে রয়েছে প্রিমিয়ার ব্যাংক। এছাড়া লেনদেনের দিক থেকে শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে- ওয়াটা কেমিক্যাল, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল, মুন্নু জুট স্টাফলার্স, প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স, কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স, সামিট পাওয়ার এবং ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্স। দেশের অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান মূল্য সূচক সিএএসপিআই ৫৯ পয়েন্ট কমে ১৪ হাজার ৪৮২ পয়েন্টে অবস্থান করছে। বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ২০ কোটি ৯১ লাখ টাকা। লেনদেনে অংশ নেয়া ২৫৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৬৩টির দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ১৬৩টির। ২৯টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।