গুজব আমাদের সমাজে ছিল এবং আছে ও থাকবে। তবে গুজবে কান দেয়া বা পা দেয়ার স্বভাব প্রকৃতির নিয়মের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে। তবে আশায় ছিলাম যে, জাতি যত শিক্ষিত ও উন্নত হবে গুজব ততই প্রস্থানের পথে গতিশীলতা নিয়ে পালাবে। কিন্তু প্রকৃতি এবং যুগের চাহিদার পরিবর্তনের সাথে সাথে গুজব নামক শব্দটির নতুন সংস্করণ বা নব আবিস্কার এখন ডিজিটাল সংস্করণে সমাজে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। গুজব এবং উস্কানি দুটো শব্দই আবার বাংলা অভিধানে আছে। কিন্তু ইদানিংকালে দু:খজনক হলেও সত্য যে, কিছু সংখ্যক সুবিধাবাদী দল, গ্রুপ বা শ্রেণী ও মতের এবং পথের মানুষগুলি এদুটোকে ব্যবহার করে সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট করে যাচ্ছে। গ্রামের সেই পুরোনো কথার পুনরাবৃত্তি করে স্মরণ করে দিতে চাই “চিলে কান নিয়ে গেছে আর চিলের পিছনে ছুটছে দেশ ও জাতি। সেই কথা সত্যতা এখনো বিরাজমান রয়েছে; তবে বর্তমান ডিজিটাল যুগে এর উল্টোটা হওয়া কথা ছিল। কেউ বললো আপনার কান চিলে নিয়ে গেছে কিন্তু আপনি কানে হাত না দিয়ে চিলের পিছনে দৌঁড়ানো বোকামী ছাড়া আর কি? তবে আরো কঠিন একটি কথা বলতে চাই বিষয়ে- আমার দাদা প্রায়ই বলতো যে, তার দাদা খুবই শক্তিশালী সৎ ও জ্ঞানী এবং পরহেজগার মানুষ ছিলেন; কিন্তু তিনি খুবই রাগীও ছিলেন। একদিন ওনি কাজ করছেন (পানিতে পাট ধুয়ে পরিস্কার করছেন) আর পরিস্কার করা পাটগুলো একটি নৌকায় রাখছেন। কিন্তু নৌকাটি এক জায়গায় না থেকে বিভিন্ন দিকে ছুটাছোটি করে যাচ্ছেন। এই দেখে দাদার দাদা বিরক্ত হয়ে নৌকাটিকে বলছেন দাড়াও তোমাকে মজা দেখাচ্ছি। এই বলে তিনি রাগে-ক্ষোভে তিক্ত-বিরক্ত হয়ে একটি লাম্বা বাশের খুটি (চখুইর) নিয়ে নৌকাটি দ্রুত গতিতে চালাতে লাগলেন এমনকি মাইল দুইয়েক চালিয়ে ফিরে এসে নৌকাটিকে বললেন তোমার নড়া-চড়ার সাধ মিটিয়ে দিয়েছি। আর নড়া চড়া করার সাহস হবে না। এবার বুঝেছেন আমরা এই হুজুগে জেগে উঠার ফল এবং গুজবে কান বা পা দেয়ার ফলও কি তাই না। একটু চিন্তা করুন নৌকাটির কোন ক্ষমতা নেই নড়া চড়া করার কিন্তু বাতাসের ক্ষমতা ছিল নৌকাটিকে এদিক সেদিক নাড়ানোর। তাই বুদ্ধিপূর্বক কিছু না করে নিজের সর্বনাশ করেছেন ঐ দাদার দাদা। প্রথমত সময় নষ্ট এবং দ্বিতীয়ত শক্তির অপচর এমনকি নিজেই পরিশ্রান্ত হয়ে ফিরে এসে নৌকার উপর দায় চাপিয়ে স্বস্তি পাচ্ছেন। আমরাওকি তাই করে যাচ্ছি না। একটু বুদ্ধি-বিবেক ও বিবেচনা করে এগুলে হয়তো দাদার দাদা সময়মত কাজ শেষ এবং স্বল্প পরিশ্রমে অনেক কিছু পেতেন। কিন্তু আমরা জিবন বিনাশী পরিশ্রমে জড়িয়ে সর্বশান্ত হচ্ছি। আল্লাহর ইচ্ছা কিন্তু তা নয়। কারণ তিনি আমাদেরকে সুখে শান্তিতে এবং নিরাপদে রাখতে চান কিন্তু আমরা সেই সকল বিসর্জন দিয়ে সর্বশান্ত হাচ্ছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও কি ঐ জড় বস্তু নৌকাটির মত নয়! আমরা কি ঐ দাদার দাদার মত নয়!
আমাদের সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বা মাধ্যমগুলোয় মানুষ কতকিছুই না বলে, প্রকাশিত হয় এবং লিখে মনের ভাব প্রকাশ করে। কেউ কেউ আবার শয়তান দ্বারা প্রলোভিত হয়ে সমাজে ফ্যাতনা ফ্যাসাদ সৃষ্টিতে ভুমিকা রাখে। ইসলাম শান্তির ধর্ম, স্থীতিশীলতার ধর্ম, সাম্যের ধর্ম, নিরহংকারের ধর্ম। সকল মত ও পথের মানুষের কল্যাণের ধর্ম। সকল মত ও পথের মানুষকে একত্রিত করে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্যে পৌঁছানোর ধর্ম। কিন্তু কেউ ইসলাম রক্ষার প্রয়োজনে জীবন দেয়ার দরকার নেই বরং সৃষ্টিকর্তা তাঁর সৃষ্ট ধর্মকে রক্ষায় স্বীয় ক্ষমতায়ই যথেষ্ট। ইসলাম এত ঠুনকো নয় যে, সামাজিক যোগাযোগে কেউ গালি দিলেই ইসলাম শেষ হয়ে যাবে বা গেছে, নবী রাসুল সা: কে অবমাননা করা হয়েছে এরকম ভাবা কতটুকু সঠিক তা আজকের দিনে ইসলামী স্কলারস্ গণ গভেষণা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার খুব বেশী প্রয়োজন অনুভব করছি। সমাজে ফেৎনা সৃষ্টি করা ইসলামে নিষেধ করা হয়েছে। ইসলাম মানেই শান্তি। কিন্তু সেই শান্তি বিনষ্ট করা বর্তমান যুগের মুসলিমদের জন্য বুদ্দিমানের কাজ নয়। ইসলামকে যুগে যুগে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজনের সঙ্গেও খ্যাপ খায় না। বর্তমান সময়ে শয়তানের পাতা ফাঁদে না বুঝে শুধুমাত্র আবেগ দিয়ে মুসলমানদের পা ফেলা সঠিক বা বুদ্ধিমানের কাজ বলে বিবেচিত হতে পারে না। তারা উৎ পেতেই আছে ইসলামকে জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ, সন্ত্রাসী আখ্যা দেয়ার জন্য। আল্লাহ সকল জাতির জন্যই নবী ও রাসুল পাঠিয়েছেন। কোন জাতিই এর বাইরে নয়। কিন্তু সকল নবী রাসুলগণই অত্যাচারিত ও নির্যাতিত হয়েছেন। আর তখন তারা অত্যাচার ও নির্যাতনের কোন প্রতিশোধ নেননি, ক্ষমা করেছেন, ধৈয্য ধরেছেন। একটি কিতাবের আয়াত এই ক্ষেত্রে উর্বর ভুমিকা রাখে; অত্যাচার ও নির্যাচন শয্য করার ক্ষেত্রে ঈসা আল মসিহ বলেছেন “কেউ যদি তোমার ডান গালে চর মারে তাহলে বাম গালও পেতে দিয়ো যাতে আরেকটি চর মারতে পারে।” আর তিনি সাহাবিদের এক প্রশ্নে বলেছেন সাত গুন সত্তর বার ক্ষমা করো। যদি এই হয় আমাদের অবস্থান তাহলে আল্লাহ সকল কিছুর উপর বিজয় দান করবেন; সুনিশ্চিত হবে শান্তি ও শৃঙ্খলা। এই ক্ষেত্রে হযরত মুহাম্মদ (স:) এর জীবনে সবচেয়ে বেশী কষ্ট বা অমানবিক নির্যাতনের স্বীকার হয়েছিল তায়েফে আর তখন জিবরাইল (আ:)হাজির হয়ে রাসুলের অনুমতি চেয়েছিল এবং বলেছিল আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে তায়েফের জমিনকে উল্টিয়ে দেয় যাতে তায়েফের সকল মানুষ মাটিচাপা পড়ে শেষ হয়ে যায়। নবিজি জিবরাইলকে নিষেধ করে বললেন আমাকে আল্লাহ পাঠিয়েছে মানুষের রহমত স্বরূপ। পবিত্র কোরআনের ১০৩ নং সূরার মধ্যে আল্লাহ যে ৪টা গুনের কথা বলেছেন সেগুলোর দিকে বেশী গুরুত্ব দেই। (১) ঈমান (২) নেক আমল (৩) সত্য (৪) ধৈর্য্য। আল্লাহ আমাদের সকলের হিংসা, বিদ্ধেষ, প্রতিহিংসা ভ’লে ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে ধৈর্য্য সহকারে চলার তৌফিক দিন।
গুজবের ফাঁদে পা দেয়ার কি ফল তা কিন্তু দেশবাসী দেখেছে- বিশেষ করে বিগত দিনগুলোর কথাও মনে আছে:Ñ রামু, রংপুর, নাসিরনগর সর্বশেষ ভোলার বোরহান উদ্দিন। ঐ ঘটনায় কি ক্ষতি হয়েছিল:Ñ প্রথমত মানুষের জীবন নাশ, দ্বিতীয়ত অর্থ ও সম্পদের ক্ষতি; তৃতীয়ত শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিনাশ, চতুর্থত দেশের নামের আগে কলঙ্কের তিলক আটা; পঞ্চমত শয়তানের রাজ্যের মানুষদেরকে শয়তানি করার সুযোগ করে দেয়া যাতে শয়তানির বেড়াজালে আবদ্ধ করে জাহান্নামি শাস্তি কায়েম চলমান রাখতে পারে। আমরা যদি এই বিষয়গুলোকে নিয়ে একটু চিন্তা করি এবং চিন্তাশীল মানুষগুলো যদি একত্রিত হয়ে সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে বিশেষ করে স্কুল-কলেজ; মক্তব এবং মসজিদের নামাজের পূর্বে একটু সচেতনার জ্ঞান দিয়ে হুজুগে বা গুজবের ফাঁদে না পড়ার জন্য ব্যাখ্যা করি তাহলে জাতি জাগ্রত হবে এবং এই নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলায় আর উজ্জীবিত হবে না। ইসলামের শান্তি ও স্থীতিশীলতায় বিরজমান থাকবে। ইসলামের নামে নেতিবাচকতা এবং আবেগে উত্তেজিত হয়ে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়ার মতো কোন আচরণ প্রকাশ করার সুযোগ দেয়া যাবে না ততক্ষণ যতক্ষন আমাদের সকল স্তরের মানুষ স্ব ও সু শিক্ষায় শিক্ষিত না হবে। ধর্মীয় স্ব ও সু শিক্ষার ক্ষেত্রগুলোকে আরো তৎপর হয়ে কার্যকরি ভুমিকা রাখতে হবে। যুদ্ধংদেহী মনোভাব ত্যাগ করে উত্তপ্ত মরুভ’মীতে পানি ঢালার ব্যবস্থার মাধ্যমে ধর্মকে আরো শক্তিশালি এবং শান্তি ও স্থিতিশীলতায় গতিশীলতা দিয়ে মানুষের মনে স্থান করে দিতে হবে। ভয়-ভীতির উদ্ধে ধর্মকে স্থান করে দিতে হবে। মানুষের স্বাধীনতা ও মত প্রকাশে বাধাস্বরূপ না হয়ে বরং সুযোগ দিয়ে ধর্মকে আরে গ্রহনযোগ্য করে সবাইকে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্যে পৌঁছার সুযোগ করে দিতে হবে। যাতে সকল মানুষই আল্লাহর কাছে ফিরে গিয়ে বেহেস্তে বসবাস করতে পারে। যুদ্ধ করে জীবন দিয়ে বেহেস্তে না গিয়ে বরং যুদ্ধকে থামিয়ে শান্তি দিয়ে সমগ্র পৃথিবীকে ভরিয়ে দিয়ে বেহেস্তবাসী হওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই আল্লাহর শেষ ইচ্ছা বা অভিপ্রায় বা আখাঙ্খা পরিপূর্ণ হবে।
গুজব সকল ক্ষেত্রে হচ্ছে; শুধু যে ধর্মীয় ক্ষেত্রে হচ্ছে তা কিন্তু নয় বরং রাজনীতি, অর্থনীতি, সরকার এমনকি সমাজের সকল পর্যায়েই এর অবস্থান রয়েছে। তাই সকল পর্যায় থেকে এর বিতারণ এখন সময়ের দাবি। তাই আমাদের রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, হুজুর, এমনকি সমাজের দৃষ্টান্তবহনকারী মানুষগুলো একত্রিত হয়ে এই গুজব নামক শব্দটিকে উস্কানী নামক শব্দটি থেকে আলাদা করি এবং এই দুইটি শব্দের নেতিবাচক ব্যবহার বন্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে ইতিবাচক ব্যবহারের ভুমিকা রাখি। আগামীর কল্যাণের তরে এখনই এই অভিষাপগুলো মুচনে তৎপর হই। সমাজের সকলের জন্যই এই বিষফোর শব্দ দুটি মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তাই ধর্ম-বর্র্ণ, ভিন্ন মত ও পথ এবং গোত্র এমনকি ছোট-বড়, উঁচু-নিচু ভেদাভেদ; মোটকথা বাংলাদেশের অধিভুক্ত সকল মানুষই সকলের কল্যাণের তরে এগিয়ে আসা বাস্তবতার নিরীখে সময়ের উর্বর দাবি।