প্রশান্তি ডেক্স ॥ রাজধানীর প্রেসক্লাব এলাকায় ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে সরকারি ছুটির দিন ছাড়া ৪৫ টাকা দরে পেঁয়াজ বিক্রি করে টিসিবি। গত মঙ্গলবার (২৯ অক্টোবর) দুপুর দেড়টায় ট্রাকের সামনে লাইনে প্রায় ২০ জন রেখেই শেষ হয়ে যায় টিবিসির পেঁয়াজ। এতে লাইনে থাকা সবার মাঝেই হাহাকার শোনা যায়। লাইনে থাকা গৃহিনী আয়শা জানান, আধাঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও তিনি পেঁয়াজ পেলেন না। বাজারে ১২০ টাকা পেঁয়াজ, টিসিবি বিক্রি করছে তার অর্ধেকে। বেশি দামেই খোলা বাজার থেকে পেঁয়াজ কেনা ছাড়া উপায় নেই। টিসিবি পেঁয়াজের পরিমাণ আরও বাড়ানোর দাবি করেন তিনি। একমাসেরও বেশি সময় ধরে পেঁয়াজের দাম আকাশছোঁয়া। দামের নৈরাজ্য থামছেই না। প্রতিদিনই যেন আগের দিনের সর্বোচ্চ দাম ছাড়ানোর প্রতিযোগীতা চলছে। খোলা বাজারে বিক্রি, আমদানি করে দামে লাগাম টানা যাচ্ছে না। দাম বাড়তে বাড়তে ১৫০ টাকা ছুঁইছুঁই করছে। অথচ, দেড় মাসে আগেও পেঁয়াজের দাম ছিল ৫০ টাকায়। কয়েক দিনের মধ্যে দাম স্বাভাবিক হবে, মাস খানেক ধরেই এমন বক্তব্য দিচ্ছে বাণিজ্যমন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা। তবে তার বাস্তব কোন প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না বাজারে। গত মঙ্গলবার (২৯ অক্টোবর) রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজ ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। কোন কোন দোকানী আরও বেশিও চেয়েছেন। আর আমদানি করা ভারতের পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১২০ থেকে ১২৫ টাকায়। দুই দিনের ব্যবধানেই পাইকারি ও খুচরা— উভয় বাজারেই পেঁয়াজের দাম আরও ২০ টাকা করে বেড়েছে। কারওয়ান বাজারে পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের কেজি ১২০ থেকে ১২৫ টাকার ঘরে। ভারতীয় পেঁয়াজও ১১০ থেকে ১২০ টাকা। আর মিসরের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকা কেজিতে। এদিকে দাম বৃদ্ধি নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বিক্রেতারা বলছেন, পাইকারি বাজারে দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ কমায় বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। যার প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে। আর ক্রেতারা বলছেন, বাজারে যে পেঁয়াজ রয়েছে, যার সিংগ ভাগই দেশি পেঁয়াজ। তাছাড়া দেশি পেঁয়াজের মজুদ হয়েছিল ভরা মৌসুমে ১০ থেকে ১১ টাকা দামে। এখন দাম ১০ থেকে ১২ গুণ বেড়ে বেড়ে যাওয়ার কোন কারণই থাকনে পারেনা। তবে পাইকারী বিক্রেতারা বলছেন, পেঁয়াজের দাম খুব বেশি ওঠা-নামা করছে। মোকামগুলোতে দাম বেড়েই চলছে। বেশি দামে কিনে আনায় বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। আগের চেয়ে এখন পেঁয়াজের বিক্রিও কম। দাম বাড়তি থাকায় ক্ষতির মুখে পড়ছছেন। বাজারে বার্মার পেঁয়াজ নেই। কারওয়ান বাজারের পাইকারি বিক্রেতা খান এন্ড সন্সের মোন. লোকমান শেখ বলেন, পেঁয়াজের দাম এখনও বেড়েই চলছে। একেক দিন একেক দামে কিনতে হচ্ছে। বিক্রি হচ্ছে সেভাবে। সবচেয়ে কম দামের আমদানি করা মিসরের পেঁয়াজও এখন ৯৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। অথচ মাস খানেক আগে যখন আমদানির শুরুতে দাম ছিল ৬০ টাকা। বাজারে নতুন পেঁয়াজ উঠতেও অন্তত দুই মাস সময় লাগবে বাকি আছে। তাই সহসাই দাম কমবে বলে মনে করেন না এই পাইকার। শ্যাম বাজারের পাইকারী ব্যববসায়ী ও আমদানি কারক ওয়াহিদ হাসান রনি বলেন, ভারতের পেঁয়াজ আদমানি বন্ধ থাকায় দাম বাড়ছে। তবে খুচরায় যে পরিমান দাম বড়েছে পাইকারীতে সে রকম বাড়ে নি। শ্যাম বাজারে এখন দেশি পেঁয়াজ ১০৮ থেকে ১১০ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারের যে দেশি পেঁয়াজ তাতো মৌসুমে ১০ টাকা ছিল, এখন দাম এতো বেশি কেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বাজারের পেঁয়াজ আসে মূলত বিভিন্ন জেলার ব্যাপারিদের কাছ থেকে। তারা শ্যামবাজার বিভিন্ন আড়তে তা সরবরাহ করে। এক্ষেত্রে আড়তদাররা শুধু কমিশন পায় মাত্র। তাদের কমিশন সব সময় একই থাকে। দাম কমা বা বাড়া তাদের হাতেই নিয়ন্ত্রিত হয়। কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, মাস খানে ধরেই পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা রয়েছে। বর্তমানে বাজারে যে হারে পেঁয়াজের দাম বাড়ছে তা অযৌক্তিক। সরবরাহ কমায় দাম বাড়তে পারে, তবে যে হারে বাড়ছে তা কাম্য নয়। সরকারের উচিত যেসব ব্যপারি পেঁয়াজ অবৈধ ভাবে মজুদ করে রেখেছে তা খুজে বের করা। এসব পেঁয়াজ জব্দ করে তা খোলা বাজারে বিক্রির ব্যবস্থা করা উচিত। একই সঙ্গে এর সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ুন কবির বলেন, সাধারণ মানুষের চাহিদার প্রেক্ষতেই টিসিবি খোলা বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করেছে। শুরুতে দিনে ৫০০ কেজি সরবরাহ করা হলেও এখন তা বাড়িয়ে ৩৫০০ কোজি করা হয়েছে। তবে আরও বেশি চাহিদা রয়েছে। কিন্তু টিসিবির সীমাবদ্ধতার কারণে এখন আর বেশি সরবরাহ বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। কেননা, দরপত্রের মাধ্যমে টিসিবি পেঁয়াজ সংগ্রহ করে। এক সঙ্গে এতো বেশি পেঁয়াজ পাওয়াও যাচ্ছেনা। তাই এখন যে হারে বিক্রি হচ্ছে মন্ত্রণালয়ের পরবর্তী ঘোষণার আগ পর্যন্ত এ হারেই বিক্রি অব্যাহত থাকবে। জানা গেছে, পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা শুরু হয় গেল মাসের মাঝামাঝিতে। পেঁয়াজ আমদানি করা হয় মূলত প্রতিবেশি দেশ ভারত থেকে। গেল ২৯ সেপ্টেম্বর দেশটি তাদের অভ্যন্তরীণ বাজার নিয়ন্ত্রণে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলে এদেশের বাজারে হুঁ-হুঁ করে বাড়তে থাকে দর। এক দিনের ব্যবধানেই দেশি পেঁয়াজ ১২০ টাকা এবং ভারতীয় পেয়াঁজ ১০০ টাকায় পৌঁছে। অথচ দেড় মাস আগেও পেঁয়াজের বাজারদর ছিল ৩০ টাকা। বাজার স্বভাবিক করতে মিয়ানমার, মিশরসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পেয়াজ আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয়। খোলা বাজারে ৪৫ টাকা দরে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করেছে সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। কিন্তু কোন কিছুতেই দাম নিয়ন্ত্রণে আসছে না। মাঝে কয়েকদিন দাম কিছুটা কমার পর আবারও বাড়তে শুরু করেছে। তবে বিক্রেতারা সরবরাহ কমার কথা বললেও পরিসংখ্যান বলছে বাজারে সরবরাহ সংকট তেমন নেই। এমনকি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরাও মনে করেন দাম এতটা বাড়ার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে মোট পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৩ লাখ টন। এরমধ্যে ৩০ শতাংশ সংগ্রহকালীন ও সংরক্ষণকালীন ক্ষতি বাদ দিলে নিট উৎপাদন দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ৩০ লাখ টন। আবার বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, একই সময়ে দেশে ১০ লাখ ৯১ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। তাছাড়া চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে আরও সোয়া ২ লাখ ১৩ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। সবমিলিয়ে মোট পেঁয়াজের সরবরাহ দাঁড়াচ্ছে ২৯ লাখ টনের বেশি। অথচ দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ টন। তাই দেশে যে পেঁয়াজ আছে তা চাহিদার অনেক বেশি। তবুও অসাধু ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো দামে পেঁয়াজ বিক্রি করছেন। এতে বিপাকে পড়েছেন স্বল্প আয়ের মানুষ।