বিদেশি মদের সংকটে ফেনসিডিল ইয়াবায় আসক্তের সংখ্যা বাড়ছে

প্রশান্তি ডেক্স ॥ মাত্র দুই মাস আগেও রাজধানীর বিভিন্ন বারে সাধারণ মানের এক লিটার বিদেশি মদ সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার টাকায় এবং ডিলাক্স ব্রান্ডের স্কচ-হুইস্কি ছয় থেকে সাড়ে ছয় হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। ওয়্যার হাউস ও ডিউটি ফ্রি শপে এর দাম ছিল আরো কম। সেখান থেকে শুধুমাত্র ফরেন পাসপোর্টধারী ব্যক্তির কাছে মদ বিক্রির কথা থাকলেও কিছুটা ‘উপরি’ দিলেই যে কেউ সেখান থেকে অনায়াসেই মদ কিনতে পারতেন। বোতলপ্রতি পাঁচ-ছয়শ’ টাকা বেশি দিলেই এলাকার ক্লাবে কিংবা ঘরে বসেই সোর্সের মাধ্যমে তা সংগ্রহ করা যেত। অথচ গত ১৮ অক্টোবর শুদ্ধি অভিযান শুরুর পর সাধারণ মানের বিদেশি মদ প্রতি বোতলের দাম ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা এবং ডিলাক্স ব্রান্ডের স্কচ-হুইস্কি প্রতি বোতল ২৫ থেকে ২৭ হাজার টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।
পাশাপাশি বিদেশ থেকে মদ-বিয়ার আমদানি এবং তা বিক্রির উপর নজরদারি বাড়ায় এর সহজলভ্যতার চিত্রও রাতারাতি পাল্টে গেছে। বিশেষ করে ফু-ওয়াং ক্লাব ও ইস্টার্ন ডিপেস্নামেটিক ওয়্যার হাউসে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ উদ্ধার এবং পরে তা সিলগালা করে দেওয়ায় ঢাকার বারগুলোতে নতুন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি যেসব বারে শুধুমাত্র দেশি মদ বিক্রির অনুমোদন রয়েছে, ওইসব প্রতিষ্ঠানও নির্ধারিত ক্রেতার কাছে মদ বেচতেও সতর্ক হয়ে উঠেছে। বিগত সময় এসব বারে প্রকাশ্যে বিদেশি মদ বিক্রি হলে এখন সেখানে দেশি মদ বিক্রির আগেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মদ পানের লাইসেন্স যাচাই করা হচ্ছে। ফলে দুই মাস আগেও যেসব মাদকসেবী টাকা হলেই ঘরে বসে বিদেশি মদের অর্ডার দিয়ে নির্বিঘ্নে আসর জমিয়েছেন, তারা এখন দেশি মদ জোগাড় করতেই হিমসিম খাচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে কেউ কেউ তড়িঘড়ি করে নিজ নামে মদ পানের লাইসেন্স তৈরি করে দেশি মদের দিকে ঝুঁকলেও বিদেশি মদ পানে আসক্তদের একটি বড় অংশ এখন ইয়াবা কিংবা ফেনসিডিল সেবীদের কাতারে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। বিজিবি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, মাদকের বিরুদ্ধে সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা দেওয়ার পর তাদের সাঁড়াশি অভিযানে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ইয়াবা পাচার আশানুরূপভাবে কমে আসে। গত বছর এক কোটি ২৭ লাখ ইয়াবা উদ্ধার করা হলেও এ বছরের প্রথম সাত মাসে উদ্ধার হয়েছে ৫৩ লাখ ৬৩ হাজার ২৫৫ পিস ইয়াবা। অর্থাৎ এ বছর প্রতি মাসে গড়ে উদ্ধার করা হয়েছে ৭ লাখ ৬৬ হাজার ১৭৯ পিস ইয়াবা। তবে শুদ্ধি অভিযান শুরুর পর এ গড় চিত্র সোয়া ৮ লাখে এসে ঠেকেছে। এ হিসাবে ইয়াবা উদ্ধার ৭ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়েছে।
বিজিবির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, ইয়াবা পাচার ও উদ্ধারের সঙ্গে সুনির্দিষ্ট যোগসূত্র না থাকলেও এর সরবরাহ বাড়লে স্বাভাবিকভাবে উদ্ধারের সংখ্যাও কিছুটা বাড়ে। সে বিবেচনায় গত প্রায় দুই মাসে ইয়াবা পাচারের সঙ্গে সঙ্গে এতে আসক্তের সংখ্যা ফের কিছুটা বেড়েছে এটা ধরেই নেওয়ায় যায়- যোগ করেন ওই বিজিবি কর্মকর্তা। তাদের অনুমান যে একেবারে অমূলক নয়, তা মাদক ব্যবসায়ী ও সেবনকারীদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তারা জানান, মাত্র দুই মাস আগেও যারা বিদেশি মদ-বিয়ার ছাড়া অন্য কোনো মাদকদ্রব্য ছুঁয়েও দেখতেন না, তাদের অনেকে এখন ইয়াবার নেশায় ধীরে ধীরে আসক্ত হয়ে পড়েছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ সুযোগ পেলে বিদেশি মদ পান করলেও বাকিদের বড় একটি অংশ ইয়াবার গন্ডিতেই বন্দি থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। তারা মনে করেন, বিদেশি মদের ব্যাপারে প্রশাসন যেভাবে কড়াকড়ি আরোপ করছে, তাতে আগামীতে তা আরো দুঃষ্প্রাপ্য হয়ে উঠবে। এছাড়া এর দাম আরো কয়েক গুণ বাড়বে। যা তাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। তাই ইয়াবার নেশা ধরে থাকাই তাদের জন্য সমীচীন হবে বলে মনে করছেন অনেকেই। একাধিক প্রতিষ্ঠিত চাকরিজীবী, বায়িং হাউস কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে বলেন, পেশাগত ও ব্যবসায়িক স্বার্থে তারা শুরুতে কালেভদ্রে দু-একদিন মদ পান করলেও তা এখন রীতিমতো নেশায় পরিণত হয়েছে। যা হঠাৎ করে ছেড়ে দেওয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছে। দেশি মদের স্বাভাবিক সরবরাহ থাকলেও এর মান নিয়ে প্রশ্ন থাকায় তা তারা গ্রহণ করতে পারছেন না। এছাড়া দেশি মদ সংগ্রহ করতে হলে মদ পানের লাইসেন্স দেখাতে হচ্ছে। অথচ মদ পানের লাইসেন্সে এখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ছবি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তাই সামাজিক মান-মর্যদার কথা ভেবে অনেকেই মদপানের লাইসেন্স গ্রহণ করছেন না। আর এসব কারণেই তাদের অনেকে এখন ইয়াবার মতো সহজলভ্য মাদকের দিকে ঝুঁকেছেন। বিদেশি মদ-বিয়ার সরবরাহকারী, ইয়াবার খুচরা বিক্রেতা ও ক্যারিয়ারদের সঙ্গে কথা বলেও একই ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। গত প্রায় ১০ বছর থেকে গুলশানের বিভিন্ন ওয়্যার হাউস থেকে বিদেশি মদ কিনে পাড়া-মহলস্নার ক্লাবে সরবরাহকারী নিয়াজুল নামের এক ব্যক্তি জানান, গত প্রায় দুই মাস ধরে তার ব্যবসা বন্ধ থাকায় তিনি এখন ইয়াবার কারবারিদের সঙ্গে ভিড়েছেন। তার আগের কাস্টমারদের প্রায় বেশিরভাগই এখন তার কাছ থেকে নিয়মিত ইয়াবা কিনছেন। তার মতো আরো অনেকেই আগের ব্যবসা ছেড়ে ইয়াবার ক্যারিয়ার হয়েছেন বলেও জানান নিয়াজুল। এদিকে মাদকের রাজ্যে অনেকটা হারিয়ে যাওয়া ফেনসিডিলের সরবরাহ হঠাৎ করেই বেড়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, মাস দুয়েক আগেও মাদক কারবারিদের বেশির ভাগ ইয়াবা, গাঁজা ও দেশি-বিদেশি মদ-বিয়ারসহ ধরা পড়লেও ইদানীং তাদের কাছে ফেনসিডিলেরও ছোট চালান মিলছে। সম্প্রতি গোয়েন্দা পুলিশ ডিবি,র্ যাব, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও বিজিবির হাতে ভারত থেকে আসা বেশ কয়েকটি ফেনসিডিলের বড় চালান ধরা পড়েছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক পদমর্যদার একজন কর্মকর্তা জানান, তারা বিভিন্ন সময়ে ফেনসিডিল উদ্ধারের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, সম্প্রতি এই মাদকের চোরাচালান প্রায় ২০ শতাংশ বেড়েছে। এ প্রসঙ্গে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা) মোসাদ্দেক হোসেন রেজা বলেন, ‘মাঝখানে একটু কমে এলেও ফেনসিডিলের চাহিদা আগের চেয়ে বেড়েছে। আমরা অন্যান্য মাদকের মতো এটিও নির্মূলের চেষ্টা করছি।’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশের অন্তত ২১টি সীমান্ত ঘেঁষা জেলার ওপারে (ভারতে) মাদক কারবারিরা নতুন করে ফেনসিডিল কারখানা স্থাপন করেছে। রাতের আঁধারে সীমান্ত হয়ে সেখান থেকে ফেনসিডিল ঢাকায় আসছে। সম্প্রতি বিজিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিজেদের একাধিক বৈঠকে ফেনসিডিল চোরাচালান বেড়ে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাতক্ষীরা, যশোর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, শ্রীমঙ্গল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লœা ও ফেনী জেলার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে নতুন করে ফেনসিডিল আসতে শুরু করেছে। গোয়েন্দা ওই প্রতিবেদনে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগর, বহরমপুর, মালদা, কুচবিহারের পাশের ফলাকাটা, মেঘালয়ের তুরা ও সিলেট সীমান্তের অদূরে জোয়াই এলাকায় ফের ফেনসিডিলের কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এদিকে ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য পাচার, বেচাকেনা ও সরবরাহের সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে উৎকণ্ঠিত হওয়ার মতো বেশকিছু তথ্য পাওয়া গেছে। তারা জানান, মাদকের রাজ্যে এখন রীতিমতো ‘মার্কেটিং পলিসি’ অনুসরণ করা হচ্ছে। অন্যান্য পণ্যের মতো বিভিন্ন জায়গায় এর ‘পুশিং সেলও’ শুরু হয়েছে। বিশেষ করে নতুন করে বাজারে ফেরা ভারতীয় ফেনসিডিলে যাতে মাদকাসক্তদের ঝোঁক না বাড়ে এ জন্য সাময়িক সময়ের জন্য কম দামে ইয়াবা বিক্রির ছক তৈরি করা হয়েছে। তবে মাদকাসক্তদের কাছে ফেনসিডিলের চাহিদা কমে যাওয়ার পর ফের তারা ইয়াবা চড়া দরে বিক্রি করবে- এ আগাম পরিকল্পনাও তাদের রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.