প্রশান্তি ডেক্স্। আমূল পরিবর্তন আনা হবে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকে। ইতোমধ্যে সারাদেশের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কারিকুলাম বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয়া হয়েছে। এখন চলছে সমন্বয় ও নতুন কারিকুলাম বা পাঠ্যক্রম প্রণয়নের কাজ। পাশাপাশি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়নে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হচ্ছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে বিভাগ তুলে দিয়ে তা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে নির্বাচন করতে হবে। পাবলিক পরীক্ষায় নম্বর কমিয়ে তা বাড়ানো হবে ক্লাস পরীক্ষার মূল্যায়নে। শিক্ষার মানোন্নয়নে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিয়ে গঠিত কমিটির সুপারিশের আলোকে এসব সিদ্ধান্ত ২০২৪ সাল থেকে বাস্তবায়ন হবে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, ‘কারিকুলাম পরিবর্তনের কাজ ২০১৭ সাল থেকে শুরু করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এটি বাস্তবায়ন করা হবে। ২০২৩ সালে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন সম্পন্ন করার টার্গেট রয়েছে। সে লক্ষ্যে কর্মযজ্ঞ চলছে। কারিকুলাম বিশেষজ্ঞরা কয়েক বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছেন।’ এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. মশিউজ্জামানও একই কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘নতুন কারিকুলাম নিয়ে কাজ চলছে। এবারই প্রথমবারের মতো প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত সব বইয়ে পরিবর্তন আসবে।’ এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, এ পরিবর্তনে নবম শ্রেণি থেকে বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক বিভাগ পছন্দের আর সুযোগ থাকবে না। ২০২৩ সাল থেকে নবম-দশম শ্রেণির সব শিক্ষার্থী একই কারিকুলামের একই পাঠ্যবই পড়ার সুযোগ পাবে। একাদশ শ্রেণিতে গিয়ে বিভাগ বিভাজন শুরু হবে। এতে একজন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক স্তরে সব বিষয়ে জ্ঞান লাভ করতে পারবে। ২০২১ সালে প্রথম ও ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী নতুন কারিকুলাম ও বই পাবে। যথাসময়ে বই পৌঁছানোর লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়ে এ স্তরের নতুন কারিকুলাম চূড়ান্ত হবে ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে। ২০২২ সালে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির এবং ২০২৩ সালে পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবইও পরিবর্তন করা হবে। পাশাপাশি ২০২২ সালে সপ্তম, নবম ও একাদশ শ্রেণির পাঠ্যবই পরিবর্তন হবে। ২০২৩ সালে পরিবর্তন আনা হবে অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে। সূত্র জানায়, কারিকুলাম পরিবর্তনের পাশাপাশি পাঠ্যবইও বদলে যাবে। এবারই প্রথমবারের মতো প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের কারিকুলাম একসঙ্গে পরিবর্তন ও সমন্বয় করা হচ্ছে। পরিবর্তিত কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান বৃদ্ধিতে সহায়ক বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হবে। পাঠ্যবইয়ে দুর্যোগব্যবস্থাপনা, জঙ্গিবাদ, নিরাপত্তার বিষয়গুলো যুক্ত করা হবে। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পাশাপাশি হাতে-কলমে দেখানোর বিষয়ও গুরুত্ব দেয়া হবে। যুক্ত থাকবে খেলাধুলাও। কারিকুলামে বড় পরিবর্তনের মধ্যে মাধ্যমিক স্তরে নবম শ্রেণি থেকে বিভাগ তুলে দিয়ে গুচ্ছ পদ্ধতি চালু করা হবে। ফলে এ স্তরে বিজ্ঞান, মানবিক বা বাণিজ্য নামে কোনো বিভাগ বা বিষয় থাকবে না। সবাইকে সব বিষয় পড়তে হবে। এতে একজন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক স্তরেই সব বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত ও জ্ঞান লাভ করবে। এ ব্যাপারে শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের মত হচ্ছে, দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর সব বিষয়ে সমান ধারণা থাকা উচিত। ২০২৩ সাল থেকে নবম শ্রেণির বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক বিভাগ উঠিয়ে দেয়া হবে এবং শিক্ষার্থীরা নতুন কারিকুলাম ও বই পাবে। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যা ও নম্বর কমিয়ে আনা। এর পরিবর্তে শ্রেণিকক্ষে ধারাবাহিক মূল্যায়নের পরিমাণ বাড়ানো হবে। শ্রেণিকক্ষে সব বিষয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়নে ২০ নম্বর রাখা হবে। এতে পাবলিক পরীক্ষার নম্বর কমে যাবে। বর্তমানে গার্হস্থ্য অর্থনীতি/কৃষি শিক্ষা পরীক্ষায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিকভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নতুন কারিকুলামে যুক্ত হবে সব বিষয়। বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ অনুযায়ী, ২০১৮ সাল থেকে চতুর্থ বিষয়ের পরীক্ষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিকভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এ মূল্যায়নের নম্বর সংশ্লিষ্ট শিক্ষাবোর্ডে পাঠানো হচ্ছে প্রতিষ্ঠান থেকে। মূল মার্কশিটে এসব বিষয়ের প্রাপ্ত নম্বর উল্লেখ থাকছে। তবে পরীক্ষার ফলে কোনো প্রভাব পড়ছে না। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মাধ্যমিক স্তরে বিভাগ বিভাজনের ফলে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা ব্যবহারিক পরীক্ষার সুযোগে বেশি নম্বর অর্জন করে। কিন্তু মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার শিক্ষার্থীদের এ সুযোগ খুবই কম। এতে তারা একধরনের বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এনসিটিবির বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশের হাইস্কুলগুলোতে প্র্যাকটিক্যাল করানোর মতো পর্যাপ্ত ল্যাবরেটরি সুবিধা বা সহকারী নেই। এরপরও বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা ১০০ নম্বর ব্যবহারিকের মধ্যে প্রায় শতভাগ নম্বর পায়। এতে মানবিক ও ব্যবসায় শাখার শিক্ষার্থীরা ফলাফলে চরম বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।
মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিয়ে ২০১৬ সালে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যদের নিয়ে একই বছরের ২৫ ও ২৬ নভেম্বর কক্সবাজারে দুদিনের আবাসিক কর্মশালা হয়। এতে শিক্ষাবিদরা যে সুপারিশ করেছিলেন তারই আলোকে কয়েকটি উপ-কমিটি গঠন করা হয়। শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা উপ-কমিটিগুলো ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর ৮ দফা প্রস্তাব করেছিল। প্রস্তাবে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষাক্রম বিষয়বস্তুর গুরুত্ব অনুসারে তিন গুচ্ছে ভাগ করার জন্য সরকারকে পরামর্শ দেয়া হয়। ‘ক’ গুচ্ছে বাংলা, ইংরেজি ও গণিত। ‘খ’ গুচ্ছে বিজ্ঞান, সমাজ পাঠ (ইতিহাস, পৌরনীতি ও ভূগোল)। ‘ক’ ও ‘খ’ গুচ্ছ বাধ্যতামূলক। আর ‘গ’ গুচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি, চারুকারুকলা, শরীরচর্চা ও খেলাখুলা, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, কৃষি ও গার্হস্থ্য, নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি। এছাড়া এর বাইরে ‘ঘ’ গুচ্ছে প্রকৌশল প্রযুক্তি (বিদ্যুৎ, যন্ত্র, কাঠ, ধাতু ইত্যাদির ব্যবহারিক জ্ঞান ও প্রয়োগ) যুক্ত করার মতো দেন শিক্ষাবিদরা। শিক্ষাবিদরা ‘গ’ গুচ্ছের বিষয়গুলোর জন্য কোনো পাবলিক পরীক্ষা না নিয়ে বিদ্যালয়েই ধারাবাহিক মূল্যায়ন করার পরামর্শ দেন। শিক্ষার্থীর ভবিষ্যতের কর্ম ও পেশা নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে নবম ও দশম শ্রেণিতে আগের শ্রেণির গুচ্ছের সঙ্গে ‘ঘ’ গুচ্ছ যুক্ত করার কথা বলেন। এই গুচ্ছে রয়েছে পদার্থ, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, উচ্চতর গণিত, হিসাব, বিপণন, ব্যবস্থাপনা ও অর্থনীতি। ‘ঘ’ গুচ্ছ থেকে যে কোনো দুটি বিষয় শিক্ষার্থীরা পছন্দ করে নিতে পারবে। শিক্ষার্থীরা ইচ্ছা করলে ‘ঘ’ গুচ্ছ থেকে ঐচ্ছিকভাবে আরও একটি বিষয় নিতে পারবে। তবে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। নবম-দশম শ্রেণিতে পাঁচটি বাধ্যতামূলক বিষয় ছাড়া ‘গ’ গুচ্ছ থেকে দুটি ও ‘ঘ’ গুচ্ছ থেকে দুটি বা তিনটি বিষয় নিতে হবে। ফলে এসএসসি পরীক্ষায় ১৪টি থেকে চারটি বিষয় কম যাবে। অর্থাৎ ঐচ্ছিক বিষয়সহ মোট ১০টি বিষয়ের পাবলিক পরীক্ষা হবে।
তবে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকরা প্রস্তাবিত গুচ্ছ পদ্ধতি সম্পর্কে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তারা বলেন, বিজ্ঞান বিভাগ তুলে দিয়ে গুচ্ছ পদ্ধতি চালু করলে বিজ্ঞান বিষয়ের গুণগত মান কমে যাবে। নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগ না থাকলে উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে শিক্ষার্থীরা বর্তমান সিলেবাসের সঙ্গে তাল মেলাতে পারবে না। কারণ বর্তমানে নবম-দশম শ্রেণির বিজ্ঞানের বিষয়ের বইগুলোয় যেসব কনটেন্ট আছে, তা মানসম্মত নয়। একাদশের যে কনটেন্ট রয়েছে, তা অনেকটাই দুর্বোধ্য মনে হয় শিক্ষার্থীদের কাছে। আর সিলেবাস রয়েছে, তাও অনেক বড় বা বেশি। এতে যে পরিমাণ শ্রেণি ও ক্লাস নেয়া হয় কলেজ পর্যায়ে তা দিয়ে সিলেবাস কাভার করা যায় না। এতে কিছুটা দুর্বল শিক্ষার্থীরা এইচএসসিতে খারাপ ফলাফল করে এবং পরে হতাশ হয়ে পড়ে।