প্রশান্তি ডেক্স ॥ দেড় ডজন ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে উন্মুক্ত নির্বাচনের সিদ্ধান্ত হাইকমান্ড থেকে ক্লিন ইমেজের প্রার্থীদের প্রস্তুত থাকার নির্দেশ নেপথ্যের ষড়যন্ত্র খোঁজার তাগিদ দলীয় নেতাদেও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের আসন্ন নির্বাচনে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে কোনো বিতর্কিত প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হবে না- দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের এ ঘোষণার পর সপ্তাহ না ঘুরতেই দলীয় সমর্থন পাওয়া কাউন্সিলর প্রার্থীদের তালিকায় ধর্ষণ, চাঁদাবাজি ও দখলবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িত ডজন দুয়েক ব্যক্তির নাম আসায় চরম বিপাকে পড়েছে আওয়ামী লীগ। সংশ্লিষ্টদের শঙ্কা, ওইসব বিতর্কিত প্রার্থীর গায়ে দলীয় তকমা লাগিয়ে জোরালো প্রচার-প্রচারণা চালালেও তাদের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এমনকি দলীয় নেতাকর্মীদেরও তাদের পক্ষে ভোট না দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে তারা বিরোধীদলীয় শক্তিশালী প্রার্থীর কাছে গো-হারা হেরে যাবে। অন্যদিকে বিতর্কিত এসব প্রার্থী কোনোভাবে নির্বাচনে জয়ী হলে তাদের অপরাধ-দুর্নীতির সম্পৃক্ততা আরও বাড়বে। যা ক্ষমতাসীন দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবে। এমনকি নির্বাচিত এসব কাউন্সিলররা দলের জন্য বোঝা হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকেই। এ পরিস্থিতিতে দলীয় হাইকমান্ড বিতর্কিত এসব প্রার্থীকে ‘মাইনাস’ করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েছে। একই সঙ্গে সব ধরনের যাচাই-বাছাই শেষে কাউন্সিলর প্রার্থীদের দলীয় সমর্থন দেওয়ার নির্দেশনা থাকলেও বিতর্কিত ব্যক্তিরা কীভাবে সে তালিকায় ঠাঁই পেলেন তা-ও গভীরভাবে অনুসন্ধান করছে। এর নেপথ্যে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে কিনা দলের নীতি-নির্ধারকরা তা খুঁজে দেখার তাগিদ দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একজন নেতা জানান, বিতর্কিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের সরাসরি বাদ না দিয়ে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের নির্বাচন দলীয়ভাবে উন্মুক্ত করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ফলে দলের অন্য যেসব নেতা ওই ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করার জন্য দলীয় মনোনয়নপত্র কিনেছিলেন তারাও নির্বিঘ্নে ভোটে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। এ জন্য বিতর্কিত প্রার্থীদের ওয়ার্ডের দলীয় সমর্থন বঞ্চিতদের নির্ধারিত সময়ের (৩১ জানুয়ারি) মধ্যে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। দলীয় সূত্র জানায়, দলে যাতে কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী না হতে পারে, এজন্য গত শনিবার মেয়র প্রার্থীদের সঙ্গে দলীয় সমর্থন প্রত্যাশী কাউন্সিলর প্রার্থীদেরও গণভবনে ডাকা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে মনোনয়ন প্রত্যাহারপত্রে সই করিয়ে নেওয়া হয়। যা মনোনয়পত্র প্রত্যাহারের আগেই নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়ার কথা ছিল। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন বিতর্কিতদের প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লিন ইমেজের প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাহারপত্র জমা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যাতে তারা নিশ্চিন্তে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা না হলেও ওইসব প্রার্থীর ভোটের মাঠের প্রস্তুতি নিয়ে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। আওয়ামী লীগের প্রথম সারির একজন নেতা জানান, কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন পাওয়া বিতর্কিত কাউন্সিলরদের তালিকা নিয়ে গত সোমবার রাতে মহানগরের কয়েকজন নেতা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে ক্লিন ইমেজের বিপুলসংখ্যক যোগ্য প্রার্থীকে বাদ দেওয়া হয়েছে বলেও তারা অভিযোগ তোলেন। এ সময় দলীয় সভানেত্রী বির্তকিত প্রার্থীদের ওয়ার্ডে উন্মুক্ত নির্বাচন দেওয়া হবে বলে আশ্বাস দেন। ঢাকা-১১ আসনের সংসদ সদস্য একেএম রহমতুল্লাহ জানান, তিনি নেত্রীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। তিনি কাউন্সিলর পদে উন্মুক্ত নির্বাচনের কথা বলেছেন। তবে মহানগর নেতাদের গণভবনে এসে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং বিতর্কিত নেতাদের তালিকা নিয়ে কথা বলার বিষয়টি স্বীকার করলেও এসব পদে উম্মুক্ত নির্বাচনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন দলের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকের বক্তব্য হলো- কয়েকজন নেত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তারা কাউন্সিলর পদে প্রার্থিতা বিষয়ে কথা বললেও উন্মুক্ত নির্বাচন নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। গণভবন সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা-৭ আসনের এমপি হাজী সেলিম, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও ঢাকা-১১ আসনের এমপি একেএম রহমতুল্লাহ বিতর্কিত প্রার্থীদের তালিকা প্রধানমন্ত্রীকে দেখান। অনেক ওয়ার্ডে ত্যাগী নেতাদের বঞ্চিত করা হয়েছে বলেও তারা অভিযোগ করেন। গংশ্লিষ্টরা জানান, ক্যাসিনোকান্ড, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, মাদক ব্যবসা, জমি দখল ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত অন্তত দুই ডজন নেতা কাউন্সিলর পদে দলীয় সমর্থন বাগিয়ে নিয়েছেন। এর মধ্যে ১৮ জন বর্তমান কাউন্সিলর রয়েছেন। এদের অনেকের বিরুদ্ধে সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থা থেকে অনুসন্ধান চলছে। বেশ কজনের ব্যাংক হিসাব তলব বা জব্দ করা হয়েছে। ‘দাগি’ এসব কাউন্সিলরের অনেকের বিদেশযাত্রায়ও সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন পাওয়া কাউন্সিলরদের মধ্যে ২ নম্বর ওয়ার্ডের আনিসুর রহমান, ৫ নম্বরের মো. আশ্রাফুজ্জামান ফরিদ, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সিরাজুল ইসলাম ভাট্টি ওরফে জামাই সিরাজ, ১২ নম্বর ওয়ার্ডের গোলাম আশরাফ তালুকদার, ২০ নম্বরের ফরিদ উদ্দিন আহমেদ রতন, ২৬ নম্বরের হাসিবুর রহমান মানিক, ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের আরিফ হোসেন, ৫১ নম্বরের হাবিবুর রহমান হাবু, ৫৬ নম্বরের মোহাম্মদ হোসেন ও ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাইদুল ইসলাম ওরফে সাইদুল মাতবর, ৫৯ নম্বর ওয়ার্ডের আকাশ কুমার ভৌমিকও নানা কারণে সমালোচিত। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন পাওয়া কাউন্সিলরদের মধ্যে রয়েছেন ৪ নম্বরের জামাল মোস্তফা, ৫ নম্বরের আবদুর রউফ নান্নু, ১৮ নম্বরের জাকির হোসেন বাবুল, ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান খান ইরান, ২৮ নম্বরের ফোরকান হোসেন, ৩০ নম্বরের আবুল হাসেম হাসু ও ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। এদিকে এসব কাউন্সিলরের বাইরে নতুন করে যাদের দলীয় সমর্থন দেওয়া হয়েছে তাদেরও বেশ কয়েকজন নানা অভিযোগে অভিযুক্ত। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১নং ওয়ার্ডে দলীয় সমর্থন পাওয়া প্রার্থী খিলগাঁও থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে নির্মাণাধীন কমিউনিটি সেন্টার দখল করে অবৈধ দোকান বসিয়ে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। শুদ্ধি অভিযান চলাকালে ক্যাসিনোকান্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগে দল থেকে বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা খালিদ মাহমুদ ভুঁইয়ার সঙ্গে ভাগেযোগে মাহবুবুল আলম চাঁদা তুলতেন- এ সংক্রান্ত সংবাদ গত ২১ ডিসেম্বর দেশের প্রথম শ্রেণির একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়। পরে স্থানীয় সাংসদের নির্দেশে খিলগাঁও থানা পুলিশ ওই কমিউনিটি সেন্টার থেকে অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদ করে তা দখলমুক্ত করে। আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা অভিযোগের সুরে জানান, বিপুলসংখ্যক বিতর্কিত প্রার্থীকে কাউন্সিলর পদে দলীয় সমর্থন দেওয়ায় তারা নিজেরাও সামাজিকভাবে বিব্রত। এ নিয়ে অনেকেই তাদের নানা কথা শোনাচ্ছেন। অথচ এর প্রতিউত্তর দিতে তারা ব্যর্থ হচ্ছেন। কেননা, এদের সম্পর্কে তাদেরও নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। ভোটের মাঠে এসব প্রার্থীর নিজস্ব লোকজন নিয়েই প্রচারণা চালাতে হবে, দলীয় নেতাকর্মীরা এতে যোগ দেবে না বলে মন্তব্য করেন তারা। এদিকে নানাভাবে যাচাইবাছাই করার পরও বিতর্কিত ব্যক্তিদের কীভাবে দলীয় সমর্থন দেওয়া হলো তা খুঁজে দেখা উচিত বলে মনে করেন ক্লিন ইমেজের প্রার্থীরা। তাদের ভাষ্য, বিতর্কিত প্রার্থীদের দলীয় সমর্থন দেওয়ার মধ্য দিয়ে বিশেষ কেউ দলকে বিতর্কিত করার ষড়যন্ত্র করছে কিনা তা এখন অনেকের কাছেই জিজ্ঞাসু হয়ে উঠেছে। তাই এ ষড়যন্ত্রের মূল উৎপাটন করা জরুরি।