প্রশান্তি ডেক্স ॥ প্রশান্তি ডেক্স ॥ আশরাফুল মামুন: প্রবাস যেন এক বনবাস । এ যেন বাংলাদেশী ভাগ্য হত প্রবাসীদের বেঁচে থাকার তরে অদৃশ্য অজানা অশুভ শক্তির সম্মুখে যুদ্ধক্ষেত্রের বিভীষিকার শঙ্কা । জীবিকার কঠোর সংগ্রামে, সমস্যার ভারে ক্লান্ত। প্রবাসে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকা এই যোদ্ধাদের নিয়ে পুরো বছরটি মঞ্চস্ত হয়েছে অনেক নাটক। শুধু নাটকই নয় সিটিং ফিটিং আর মারিং কাটিংদের কবলে পড়ে সর্বশান্ত হয়েছেন দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি এই রেমিট্যান্স যোদ্ধারা। মালয়েশিয়া প্রবাসী হারুন মিয়া বলেন, একজন অভিবাসী ইচ্ছে করে অবৈধ হয় না। দালারচক্র ইচ্ছে করে তাকে অবৈধ করে। বৈধ করে দেয়ার নামে একজন শ্রমিকের কাছ থেকে পাসপোর্ট ও টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যায়। তখন এই শ্রমিকের আর কিছু করার থাকে না। উদাহরণস্বরূপ আমি নিজেই। ২০১২ থেকে ২০১৭ সালের আগস্ট পর্যন্ত অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় ফেরারি হিসেবে কাজ করি। বাংলাদেশি দুইজন দালালের কাছে টাকা দিয়ে পারমিট করতে পারিনি ১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মালয়েশিয়ান একটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানির মাধ্যমে বৈধ হতে পেরেছি। হারুন মিয়া বলেন, আমাদের বাংলাদেশি শ্রমিকরা যদি দালালের কাছে না গিয়ে দূতাবাসের পরামর্শে ভালো কোম্পানিতে বৈধতা নিতো তা হলে তাদের সমস্যা সৃষ্টি হতো না। ২০১৬ সালে ‘রিহায়ারিং প্রোগ্রাম’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয় মালয়েশিয়া সরকার। প্রকল্পটি শেষ হয় ২০১৮ সালে । প্রতি অভিবাসীর কাছ থেকে ৬ হাজার রিঙ্গিত বা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা জমা নেয়। এ প্রকল্পে সাড়ে পাঁচ লাখ অবৈধ বাংলাদেশি নিবন্ধিত হয়েছিলেন বৈধ হওয়ার জন্য। এর মধ্যে নিবন্ধিত প্রায় তিন লাখ ৩০ হাজার শ্রমিকের ভিসাসহ বৈধতার বিষয়টি বিবেচনায় থাকলেও প্রতারকদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে তার ভিসা পাননি। এমনকি অভিযোগ করেও পরবর্তীতে তাদের টাকাও ফেরত দেয়া হয়নি। ‘টাকা দিয়েও এসব অভিবাসীরা বৈধতা পাওয়াত দূরের কথা তারা তাদের পাসপোর্টও হারিয়েছে। টাকা আর পাসপোর্ট দুনোটাই ভেন্ডর হজম করে ফেললেও বিষয়টি নিয়ে সরকার কোনো দায় নিতে চায় না। আবার ভেন্ডররাও সরকারের ওপর দায় চাপাচ্ছে। এদিকে অভিবাসী হয়রানির শিকার হলেও তাদের দায় না নিয়ে উল্টো অভিবাসীদের নিজ নিজ দেশে ফেরাতে গত ১ আগষ্ট থেকে শুরু করেছে ব্যাক ফর গুড কর্ম সূচী। আর এ কর্মসূচী শেষ হতে আর মাত্র একদিন বাকি। এ কর্মসূচীর আওতায় এ পর্যন্ত প্রায় ৪০ হাজার অবৈধ বাংলাদেশি দেশে ফিরেছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। ইমিগ্রেশন মহাপরিচালক দাতুক খায়রুল দাজাইমি দাউদ বলছেন, দৃষ্টি নিবদ্ধ ও অবিচ্ছিন্ন পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কোম্পানী ও এজেন্ট সনাক্ত করে আইনের আওয়তায় আনতে এবং মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে বসবাসের অপরাধে জানুয়ারী থেকে দেশজুড়ে ইমিগ্রেশন বিভাগ জানুয়ারি থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৬,৫৯৫ টি অভিযানে প্রায় দশ হাজার বাংলাদেশিসহ ১,৯৪,৩১৬ অবৈধ বিদেশী অভিবাসীকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ ছাড়া “অবৈধদের পাশাপাশি বিদেশী অভিবাসীদের অর্থ প্রদান বা অবৈধ ভাবে কাজে নিয়োগ দেয়ায় এমন ১,২১৬ নিয়োগকারীকেও গ্রেপ্তার করেছে অভিবাসন বিভাগ।” অবৈধ অনুপ্রবেশ ও দেশটিতে অবৈধদের বসবাস ঠেকাতে বিভাগটি কাজ করছে এবং দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার তাগিদে কোনো পক্ষের সঙ্গে আপস করা হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন অভিবাসন বিভাগের প্রধান। কালপরিক্রমায় পুরনো বছরের গ্লানী মুছে বছরের নতুন আশায় স্বপ্ন দেখছেন রেমিটেন্স যোদ্ধারা। জানুয়ারি থেকেই বিদেশি কর্মীদের বেতন বৃদ্ধি করা হচ্ছে। সর্বনি¤œ ১২০০ রিঙ্গিত ( টাকা ২৪ হাজার) কার্যকর হচ্ছে। এই বেতন কার্যকর করা হবে ৫৭ টি সিটি কর্পোরেশনের অধিনে। তবে পর্যায় ক্রমে সব সিটিতে বাড়ানো হবে বলে জানা গেছে। ১৮ ডিসেম্বর মালয়েশিয়ার মানব সম্পদ মন্ত্রী এম কুলা সেগারান এই ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, বর্তমানে চাহিদা অনুযায়ী ২২ হাজার টাকা বেতন চলা দুরহ ব্যাপার। প্রধানমন্ত্রী ড মাহাথীর মোহাম্মদের সরকার জনগণের কথা বিবেচনায় এনে বেতন বৃদ্ধির জন্য মন্ত্রিসভায় অনুমোদন দিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, বিগত সরকারের আমলে যেখানে সর্বনিম্ন বেতন ছিল ২০ হাজার টাকা। আমাদের সরকারের প্রথম বছরেই আমরা ২ হাজার টাকা বৃদ্ধি করেছিল এবং জানুয়ারি ২০২০ থেকে সেটা ২৪ হাজার টাকা কার্যকর করা হবে। এদিকে বেতন বৃদ্ধির ফলে বিদেশি অভিবাসিদেরও একই মজুরি কার্যকর হবে। বিগত দিনে যেখানে একজন শ্রমিকের বেসিক বেতন ছিল ২২ হাজার টাকা। জানুয়ারি থেকে তা বৃদ্ধি পেয়ে ২৪ হাজার টাকা হবে। এফএমএম-এর সভাপতি দাতুক সোহা থিয়ান লাই বলছেন, শ্রমিকদের অর্থ সঞ্চয়, পালিয়ে যাওয়া থেকে সুরক্ষা, স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক বিনিময় হ্রাসের মতো কিছু ইতিবাচক ফলাফল হতে পারে। তবে আরও কিছু দিক বিবেচনা করা উচিত। ১৮ ডিসেম্বর তিনি বিবৃতিতে এ মন্তব্য করে বলেন, কর্মীদের সমবিধিবদ্ধ অবদান হিসেবে বিদেশি কর্মী নিয়োগের আইনে সংশোধন করা উচিত। এ দিকে ২০২০ সালের মধ্যে বিশ্বমানে রূপ দিতে মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন কাজ করছে বলে জানিয়েছেন দেশটির অভিবাসন বিভাগের প্রধান দাতো খায়রুল দাজাইমি দাউদ।
তিনি বলেন ২০২০ সালের মধ্যে মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন বিভাগকে বিশ্বমানে রূপ দিতে তিনটি রূপরেখা দিয়েছেন। এ রূপরেখায় রয়েছে, সার্ভিসের মান উন্নত করা, অবৈধ অভিবাসীদের দমনে অভিযান আরও তীব্র করা এবং অভিবাসন তথ্য ব্যবস্থা উন্নীত করার দিকে নজর দেওয়া। একটি গবেষণায় জানা গেছে, যে প্রায় ৩৫.৪ শতাংশ শ্রমিক পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে ঋণ নেয়, ১৮.৭ শতাংশ টাকা ধারক থেকে ঋণ নেয়, স্থানীয় ব্যাংক থেকে ৭.২ শতাংশ, ভূমি বন্ধক রেখে ২.৬ শতাংশ এবং বিদেশি ব্যাংক থেকে ০.৩ শতাংশ ঋণ নেয়। মালয়েশিয়ায় অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন হারুনুর রশিদ। তিনি বলেন, সরকার শ্রম মাইগ্রেশন খরচ সস্তায় সীমাবদ্ধতার মধ্যে আনতে, নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে, এবং অভিবাসন সমস্যা এবং পুনর্গঠন সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। মালয়া ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক মো. খালেদ শুকরান বলেন, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে মাইগ্রেশন খরচ বিশ্বের সর্বোচ্চ এবং বেতন পরিসীমা সর্বনিম্ন। অভিবাসন খরচ কমাতে পদক্ষেপ গ্রহণ না করা পর্যন্ত অভিবাসী পরিবারের সুবিধা হবে না। বাংলাদেশি অভিবাসীরা খুব কম টাকা উপার্জন করে এবং তাদের বেশিরভাগ উপার্জন পরিবারের জীবনযাত্রার ব্যয় বহন করতে ব্যয় করে। শুধু তাই নয় দেশের অর্থনীতির চাকাকে তারা সচল রেখেছে। তাদের সুবিধা-অসুবিধা দেখভালের দায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তায়। ২০২০ সাল বৈধ কর্মীদের জন্য হতে পারে অপার সম্ভাবনাময় একটি বছর আর অবৈধদের হতে পারে দুশ্চিন্তায় কপাল কুচকে যাওয়ার বছর। ২০১৯ সালকে নিয়ে করা হিসাবের যোগ-বিয়োগের বাস্তব ফল যাই হউক তবে এটি সত্য যে,অবৈধদের জন্য মালয়েশিয়ায় বসবাসের সুযোগ দিনে দিনে কেবল সংকোচিত হবে।