বা আ॥ নিরাপত্তা পরিষদের মিটিং থেকে ২৪ ডিসেম্বর আমি ফিরে এলাম। ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি সকালবেলা আমাদের গোয়েন্দা সূত্র থেকে খবর পেলাম, শেখ মুজিবুর রহমানকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি আপাতত জানা যাচ্ছে না এমন এক জায়গায় চলে গেছেন এবং সেখান থেকে ঢাকায় ফেরার বন্দোবস্ত করছেন। পাকিস্তানি ইন্টারন্যাশনাল কলের ওপর নজরদারি করে এবং অন্যান্য সূত্রের বরাতে ওই দিনই বিকেল নাগাদ জানলাম, মুজিবুর রহমান বিমানে করে তুরস্কের আঙ্কারা পৌঁছেছেন এবং সেখান থেকে লন্ডনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বাংলাদেশে সদ্য গঠিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ এবং ফারুক আহমেদ চৌধুরী নামক এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ৮ জানুয়ারি সকালে দিল্লি এসে পৌঁছালেন। সামাদ আজাদ ডি পি ধরকে জানালেন, শেখ মুজিবুর রহমান ৯ জানুয়ারি বিকেলে ঢাকা ফিরবেন। তিনি এমন আভাসও দিলেন যে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেওয়ার জন্য ইন্দিরা গান্ধীকে তথা সমগ্র ভারতবাসীকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য ঢাকা যাওয়ার পথে শেখ মুজিবুর রহমান দিল্লিতে থামবেন।
মিসেস গান্ধীর নির্দেশনামতো আমরা লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনকে বললাম, তারা যেন শেখ মুজিবুর রহমানকে জানিয়ে দেয় যে এয়ার ইন্ডিয়া অথবা ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সের একটি বিশেষ ফ্লাইটে আমরা তাঁকে লন্ডন থেকে দিল্লি আনতে এবং সেখান থেকে ঢাকায় পৌঁছে দিতে চাই। বিচক্ষণতার সঙ্গে মুজিবুর রহমান এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি জানিয়ে দিলেন, তিনি ‘ব্রিটিশ ওভারসিজ এয়ারলাইনস’-এর একটি বিশেষ বিমানে আসবেন। তাঁর দিক থেকে এই সিদ্ধান্ত ছিল খুবই সোজাসাপ্টা ও যৌক্তিক। তিনি ভারতীয় কোনো বিমানে চড়ে ঢাকায় ফিরতে চাননি এ জন্য যে এতে সবার কাছে ভারতের প্রতি তাঁর নির্ভরতার বার্তা যাবে এবং এ বিষয়টিকে তিনি ভারতের প্রভাবজালে আটকা আছেন বলে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হবে। তিনি ব্রিটিশ বিমানকেই বেছে নিলেন, কারণ এতে তাঁর স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা প্রকাশ পাবে। এ ছাড়া তিনি যে স্বাধীনভাবে অন্যান্য দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়ে আগ্রহী তাও প্রকাশিত হবে।
মুজিবুর রহমান এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতের অন্য নেতারা কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন হলেন।
৯ জানুয়ারি সকাল সাড়ে সাতটায় পালাম বিমানবন্দরে মুজিবুর রহমানের বিমান অবতরণ করল। মিসেস গান্ধী এবং তাঁর মন্ত্রিসভার সব সদস্য বিমানবন্দরে মুজিবুর রহমানকে স্বাগত জানালেন। পালাম থেকে তাঁকে দিল্লি ক্যান্টনমেন্টের আর্মি প্যারেড গ্রাউন্ডে নিয়ে আসা হলো। সেখানে প্রায় এক লাখ মানুষ তাঁকে দেখার জন্য জড়ো হয়েছিল। এই বিশাল জনসমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমান ও মিসেস গান্ধী বক্তব্য রাখেন। মিসেস গান্ধী উদার, চিন্তাশীল ও তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য দেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতালাভ, বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তিতে সন্তোষ প্রকাশ করলেন। শেখ মুজিবুর রহমান ভারতবাসীকে ধন্যবাদ জানিয়ে এক আবেগঘন বক্তব্য দিলেন। তাঁর লিখিত বক্তব্যের একটি বড় অংশ লিখে দিয়েছিলেন পররাষ্ট্র দপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ে
কাজ করা চৌকস কূটনীতিক ফারুক আহমেদ চৌধুরী। তিনি সদ্য গঠিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিভাগের মহাপরিচালক এবং চিফ অব প্রটোকলের দায়িত্বে ছিলেন। এ ছাড়া তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিশেষ সহকারীর দায়িত্বও পালন করছিলেন।
ফারুক আহমেদ চৌধুরীর লেখা প্রাচীন হিন্দু পুরাণের মন্ত্রের মতো ব্যঞ্জনাময় সেই বক্তব্য আজও আমার মনে গেঁথে আছে। তাঁর অনবদ্য ভাষা মুজিবুর রহমানকে যেন প্রার্থনা–বাক্যের মতো আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল, ‘বাংলাদেশের এই অভিযাত্রা হোক অসত্য থেকে সত্যের দিকে, অন্ধকার থেকে আলোর পথে, মৃত্যু থেকে অমরত্বের পথে।’ ফারুক তাঁর লেখা ভাষণে স্বতঃস্ফূর্ত সাহিত্যিক ও আধ্যাত্মিক বোধের সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমান ঘণ্টা তিনেক দিল্লি ছিলেন। এরপর পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ এবং যাঁরা শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাগত জানানোর জন্য ঢাকা থেকে এসেছিলেন, তাঁদের সবাইকে নিয়ে তিনি ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলেন।
মুজিবুর রহমান বেলা আড়াইটা নাগাদ ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে নামেন। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং ভারতের প্রতিনিধি এ কে রায় তাঁকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানালেন। তাঁকে নিয়ে ঢাকার রাজপথে উল্লাস করতে করতে মিছিল বের হলো। প্রায় ২০ লাখ মানুষ তাঁকে স্বাগত জানাতে এসেছিল। মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার প্রথম দিন থেকেই মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করা হয়েছিল। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন সন্ধ্যাবেলাতেই তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব বুঝে নেন। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নতুন সদস্য হিসেবে এমন এক বাংলাদেশের যাত্রা শুরু
হলো, যেখানে কোনো বিদ্বেষ ও হানাহানি থাকবে না। তিনি ঘোষণা করলেন, বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে তিনি সুসম্পর্ক রাখতে চান। তিনি আশা প্রকাশ করেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সদ্য জন্ম নেওয়া এই নতুন রাষ্ট্রটির অভাব-অভিযোগ ও আশাআকাঙ্ক্ষার প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করবে।
সূত্র: জে এন দীক্ষিতের লিবারেশন অ্যান্ড বিয়ন্ড: ইন্ডিয়াবাংলাদেশ রিলেশনস বই থেকে।
লেখকঃ ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এবং মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশভারত কূটনৈতিক তৎপরতায় সক্রিয় কর্মকর্তা।