স্ত্রীর মনোবেদনা, মায়ের কান্না, বাবার পথ চেয়ে আছেন ২৩ মাসের নওশীন

প্রশান্তি ডেক্স॥ ২৩ মাস বয়সী শিশু নওশীন প্রতিদিন বাবাকে খুঁজে বেড়ায়। মায়ের কাছে জানতে চায় বাবা কই? বাবা কবে আসবে বাড়ি? মোবাইলে বাবার ছবি দেখিয়ে শিশু নওশীনকে মা এই বলে সান্ত¡না দেন, ‘বাবা কাজে গেছে, কাজ শেষ হলেই বাড়ি আসবে।’
বাবা ফেরার অপেক্ষায় প্রতিদিন এভাবে নানা ধরনের আশ্বাস দিয়ে নওশীনকে খাবার খাওয়ান আর ঘুম পাড়িয়ে দেন মা। শিশুটি ঘুমিয়ে পড়লে অঝোরে কাঁদেন, মেয়েকে দেয়া সান্ত¡না বুকের ভেতর চাপা দিয়ে মনে নানা প্রশ্ন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন মাও।পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকান্ডের পর থেকে নওশীন মায়ের এই আশ্বাসে বাবার পথ ফেরার দিকে চেয়ে আছে। চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির এক বছর পূরণ হলো বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি)।২০১৯ সালের গত ২০ ফেব্রুুয়ারি দিনগত রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ঘটে যায় স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে। চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনসহ আশপাশের ভবনে ছড়িয়ে পড়া আগুনে ৭১ জনের মৃত্যু হয়। চকবাজারের বাতাসে যেন আজও ভেসে বেড়ায় স্বজনহারাদের আহাজারি। তবে তিনটি লাশের পরিচয়ও মেলেনি আজও। অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু হওয়া ৭১ জনের মধ্যে ১৭ জনের বাড়ি নোয়াখালী।মোবাইলে বাবার ছবি দেখিয়ে শিশু নওশীনকে সান্ত¡না দেন মা চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনের আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে একজন নোয়াখালীর নাছির উদ্দিন। তার ২৩ মাস বয়সী মেয়ে নওশীন। প্রতিদিন বাবাকে খুঁজলে নানা ধরনের সান্ত¡না দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেন মা নুর নাহার।নোয়াখালীর সোনাইমড়ী উপজেলার নাটেশ্বর ইউনিয়নের মির্জানগর গ্রামে নাছির উদ্দিনের বাড়ি। চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির বছরপূর্তি উপলক্ষে তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পিনপতন নীরবতা। বছর পেরিয়ে গেলেও বাড়িটি এখনও শোকাচ্ছন্ন।বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল নাছির উদ্দিনের স্ত্রী নুর নাহারকে। কেমন আছেন জানতে চাওয়া মাত্রই চোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকে তার। কোলে অবুঝ শিশু নওশীন। মাকে কাঁদতে দেখে কান্না শুরু করে শিশুটি।
নিজের কান্না বুকে চেপে নিলেও সন্তানের কান্না কিছুতেই থামাতে পারছিলেন না মা নুর নাহার। পরে কোলে করে বাড়ির চারপাশ ঘুরিয়ে ঘরের ভেতর নিয়ে শিশুটির কান্না থামান মা। কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আবারও ঘরের বাইরে আসেন তিনি।নাছির উদ্দিনের স্ত্রীর কোলে মেয়ে নওশীন, পাশে বৃদ্ধা মা আয়েশাএরপর নুর নাহার বলতে শুরু করেন, বিয়ের তিন বছরের মাথায় স্বামীকে হারালাম। তার অকালে চলে যাওয়া আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো। নওশীন প্রতিদিন বাবার কথা জানতে চাইলে উত্তর দিতে দিতে আমি দিশেহারা।স্বামীর রেখে যাওয়া ঋণ আজও পরিশোধ করতে পারিনি। কিভাবে সামনের দিনগুলো পার করব জানি না। নিজের কথা বাদই দিলাম। সন্তানের ভবিষ্যত কি সে উত্তর আমার জানা নেই। আমার সংসারে উপার্জন করার মতো কেউ নেই। শ্বশুর অনেক আগেই মারা গেছেন। বর্তমানে আর্থিক সংকটে রয়েছি আমি। অগ্নিকান্ডে স্বামীকে হারানোর পর সরকারের পক্ষ থেকে অনেক কিছু দেয়ার আশ্বাস মিললেও এক বছরে কিছুই পাইনি। ভবিষ্যতে হবে কিনা জানি না।‘আমাকে ডাক্তার দেখানোর জন্য ঢাকায় নিতে চেয়েছিল নাছির। ডাক্তার দেখিয়ে পরেরদিন বাড়িতে দিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। ফোনে আমাকে বলেছিল ব্যাগ রেডি করে রাখেন। সব রেডি করে বসেছিলাম। কিন্তু আর আসেনি নাছির। আমার আজও চিকিৎসা করা হলো না।’ কথাগুলো বলে কেঁদে ফেলেন নাছির উদ্দিনের অসুস্থ বৃদ্ধা মা আয়েশা বেগম (৬২)।অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু হওয়া নেয়াখালীর ১৭ জনের মধ্যে ৯ জনএদিকে চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনের আগুনে বড় ছেলে জাফরকে হারিয়ে অসহায় ৭০ বছরের বৃদ্ধ বাবা সোলেমান। অগিকান্ডের পর জাফরের মরদেহ শনাক্ত করতে কয়েকদিন লেগে যায় বাবার। পরে জাফরকে বাড়ির পাশেই দাফন করা হয়। প্রতিদিন ছেলের কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন বাবা। কাঁদেন সন্তানের জন্য। ঘরে গেলে ভালো লাগে না তার।তিনি বলেন, জীবিত অবস্থায় আমার ছেলে জাফর তার এক বোনকে বিয়ে দিয়ে গেলেও আমার আরও তিন সন্তান রয়েছে। সংসারের আর্থিক অবস্থা খারাপ। কিভাবে জাফরের স্ত্রী-সন্তানরা বাঁচবে সে চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটে। সরকারের কাছে দাবি একটাই, স্বজন হারানো অসহায় পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন করুন।চুড়িহাট্টার আগুনে মৃত্যু হওয়া জাফরের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ বাবা সোলেমান অপরদিকে ৬৫ বছরের বৃদ্ধ সাহেব উল্যাহর দুঃখ-কষ্ট আরও বেশি। চুড়িহাট্টার আগুনে একসঙ্গে দুই সন্তান মাসুদ রানা ও মাহবুবুর রহমান রাজুকে হারিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চোখে অন্ধকার দেখছেন সাহেব উল্যাহ। সারাদিন মসজিদে পড়ে থাকেন তিনি। আল্লাহর কাছে তিনি শুধু জানতে চান কেন এত বড় সাজা দিলেন। সন্তানের খাটিয়া কাঁধে নিতে হল তাকে। দাফন করতে হল নিজ হাতে।চুড়িহাট্টার আগুনে ঠিক এদের মতো ১৭টি পরিবারের কেউ স্বামী, সন্তান এবং মা-বাবাকে অকালে হারিয়েছেন। অনেকেই সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে চরম কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। এদের পরিবারে নেই আনন্দ-উৎসব। স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেছে কারও কারও। স্বামীকে হারিয়ে কেউ কেউ বাবার কাঁধে বোঝা হয়েছেন।চকবাজার ট্র্যাজেডিতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু হওয়া ৭১ জনের মধ্যে ১৩ জনের বাড়ি নোয়াখালীর সোনাইমুনড়ী উপজেলার নাটেশ্বর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে। বাকি চারজন জেলার অন্যান্য উপজেলার বাসিন্দা ছিলেন।সরকারের পক্ষ থেকে এদেরকে দাফনের জন্য ২০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা ছাড়া গ্রস্ত পরিবারগুলোর ভাগ্যে এখন পর্যন্ত কিছুই জোটেনি। চুড়িহাট্টায় অগ্নিকান্ডের তদন্ত এক বছরেও শেষ হয়নি। ঘটনার এক বছর পার হলেও তদন্ত শেষ করতে পারেনি পুলিশ। দিতে পারেনি চার্জশিট।নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) তন্ময় দাস বলেন, চুড়িহাট্টার আগুনে মৃত্যু হওয়া নোয়াখালীর ১৭ জনকে দাফনের সময় সরকারের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছিল। ওই সময় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সান্ত¡না দেয়া হয়েছিল। সরকার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিলে আমরা ব্যবস্থ গ্রহণ করব। এ বিষয়ে দ্রুত উদ্যোগ নেয়ার জন্য সরকারের কাছে আমার অনুরোধ রইল।

Leave a Reply

Your email address will not be published.