প্রশান্তি ডেক্স॥ রেডিওতে শুনেছিলাম ‘আমি মেজর ডালিম বলছি, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে’। আমি বঙ্গবন্ধুর গায়ে জমাট বাধা রক্ত ভেজা গেঞ্জি দেখেছিলাম। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল তার বুক। সে এক দুঃসহ স্মৃতি। অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে এ কথাগুলো বলেন সাতক্ষীরার মাওলানা রজব আলী মোল্লা। স্মৃতির অতল তলে হাতড়ে তিনি এখনও আপন মনে সে কথা ভাবেন। ঘাতকদের গুলিতে বঙ্গবন্ধুর মতো এক বিশাল হৃদয়ের নরশার্দুলের ঝাঁঝরা হওয়া বুকের দুঃসহ দৃশ্যের স্মৃতি ভুলতেই পারেন না তিনি।
বারবার এ বুলেটিন প্রচারে সেদিন আমার ঘুম আর হয়নি। আতঙ্কে কাটে রাত। পরদিন সকালে ঢাকায় কী ঘটেছে সে খবর চারদিকে ভেসে বেড়ায়। আমি তখন মাদ্রাসার দশম শ্রেণির ছাত্র। সবকিছু বুঝে ওঠার ক্ষমতাও আমার হয়নি। শুধু জানলাম বঙ্গবন্ধু আর নেই। দু’দিন পর সেই টুঙ্গিপাড়ার মাটিতে দাঁড়িয়ে দাফনের আগে বঙ্গবন্ধুকে গোসল করানোর কাজে আমি সাহায্য করেছিলাম। মনে আছে তিব্বত ৫৭০ ব্র্যান্ডের কাপড় কাচা সাবান এনে পাশের ডোবার পানি দিয়ে গোসল করানো হয়েছিল তাকে।
সাতক্ষীরা শহরতলির মেহেদীবাগের টিনে ছাওয়া মাটির বাড়ির বারান্দায় বসে সাংবাদিকদের সঙ্গে শোকাবহ সেই স্মৃতি রোমন্থন করেন তিনি। রজব আলী মোল্লা বলেন, আগস্ট যায়, আগস্ট আসে, আসুক আগস্ট, কিন্তু ১৫ই আগস্ট যেন আর দেখতে না হয় এ জাতিকে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার নওয়াবেকী গ্রামের রজব আলী মোল্লা ১৯৭৫ সালে গোপালগঞ্জের গোবরা কওমী মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। কিছুদিন বাদে তিনি গোবরা ছেড়ে একই এলাকার গওহরডাঙা মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার একদিন পর টুঙ্গিপাড়ায় একজন দফাদার এসে সবাইকে খবর দিল গোপালগঞ্জ শহর আর্মিতে ভরে গেছে। আপনারা কেউ কোনো কথা বলবেন না। আর্মি যা বলে তাই শুনবেন।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, গোসল শেষে আর্মিতে ঘেরা ময়দানে বঙ্গবন্ধুর নামাজে জানাজায় ২৫ থেকে ৩০ জন মুসল্লি উপস্থিত ছিলেন। তাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন গওহরডাঙা মাদ্রাসার কলাখালি হুজুর।
এরপর তার কবর খোঁড়া হয়। সেখানেই শায়িত হলেন মহান স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তখন মনে হয়েছিল এক বিশাল মহীরুহকে হারালো বাঙালি জাতি। যেন একটি ইতিহাসের যবনিকা ঘটলো।
রজব আলী মোল্লা জানান, বঙ্গবন্ধুকে গোসলের কাজে অনেকের মধ্যে আরও যারা সহায়তা করেছিলেন তারা হলেন, গোপালগঞ্জের দিঘলিয়ার মো. জালাল উদ্দিন এবং পাটগাতি গ্রামের বেলায়েত হোসেন। এই জালাল উদ্দিন সাতক্ষীরার কামালনগর মসজিদের ইমাম ছিলেন। আর বেলায়েত হোসেন ছিলেন সাতক্ষীরা আনসার ক্যাম্প মসজিদের ইমাম।
দু’জনেই আজ প্রয়াত। তাদের স্মরণ করে রজব আলী বলেন, আমরা সবাই একসাথে থাকতাম। একসাথে বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও তার মায়ের কুলখানিতে অংশ নিয়েছিলাম ১৯৭৩ সালে। আমরা ছাত্র হিসেবে সেখানে পৌঁছানোর পর বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে শুনেছিলাম ‘কি রে তোরা খেয়েছিস ? খেয়ে নে’। মনে আছে তিনি আমাদের একসাথে বসিয়ে খাবার হুকুম দিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর গোসলের পর আমরা ছাত্ররা তার দাফনে অংশ নিয়েছিলাম। সেনা সদস্যরা এসেই বলেছিল ‘সময় কম, খুব তাড়াতাড়ি দাফন কর’। আমরা বলেছিলাম, গোসল না করিয়ে দাফন করানো যায় না। খুব কম সময়ের মধ্যে গোসল আর দাফন শেষ দেখে সেনা সদস্যরা হেলিকপ্টারে ফিরে গেল। কপ্টারের সেই আওয়াজ শুনে আমরাও ফিরে এলাম গহরডাঙ্গা মাদ্রাসায়।
আমি তখন গোপালগঞ্জের সিঙ্গিপাড়ায় একটি বাড়িতে লজিং থাকতাম। বাড়ির মালিকের ছেলের নাম ছিল আতাউল গনি বাদশা। তিনি একসময় সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও পরে খুলনার পুলিশ সুপার ছিলেন। শুধু সিঙ্গিপাড়া নয়; একই এলাকার নওশের মোল্লার বাড়িতে আমি লজিং থাকতাম। সেখানে বাড়ির ছেলেমেয়েদের কিতাব পড়াতাম। মসজিদ আর বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ছিল পাশাপাশি। বঙ্গবন্ধুকে সেই এলাকায়ই দাফন করা হয়।
সেদিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে মাঠে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী হেলিকপ্টার নামলো। সেখানে এলেন গোপালগঞ্জের এসডিও। গোসল এবং জানাজার সময় সেনাবাহিনীর ভয়ে সামনে আসতে সাহস করেননি অনেকে। সর্বোচ্চ ২৫ থেকে ৩০ জন আমরা অংশ নিয়ে তাকে শায়িত করেছিলাম। তখন আমার ছেলেবেলা। অনুভবে আসেনি এতোবড় ঘটনার সাক্ষী হলাম আমিও।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রজব আলী আরও বলেন, ১৯৮০ সালে তিনি দাওরায়ে হাদিস শেষ করে কুষ্টিয়ায় দুই বছর শিক্ষকতা করেন। এরপর চলে আসেন সাতক্ষীরায়। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আতাউল গনি বাদশার সহযোগিতায় পুলিশ লাইনস মসজিদে ইমামতির দায়িত্ব পান তিনি। টানা ৩২ বছর ইমামতির পর তিনি অবসরে গেছেন। এখন তার দুই ছেলে মাওলানা মাহমুদুল হাসান ও মাওলানা শরিফুজ্জামান। তারা সাতক্ষীরা থানা মসজিদ ও পুলিশ লাইন মসজিদে ইমামতি করেন। তার একমাত্র মেয়ে মুসলিমা খাতুনকে বিয়ে দিয়েছেন শহরেই।
বঙ্গবন্ধুকে গোসল করানোর কথা রজব আলী কখনও প্রকাশ করেছেন আবার কখনও চেপে গেছেন। বিশেষ করে ৭৫ পরবর্তী দীর্ঘদিন এবং পরে জোট সরকার আমলে বিষয়টি নিয়ে খানিকটা আতঙ্কেও ছিলেন তিনি। তা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে সাহস করেই ১৫ আগস্টের নানা কর্মসূচিতে রজব আলী মোল্লা বলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধুকে গোসল করিয়েছিলাম। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া তার রক্তভেজা বুকের দৃশ্য এখনও আমার চোখে ভাসছে।’ ৭৯ বছর বয়সে জীবন সায়াহ্নে আসা রজব আলী এসব নিয়ে এখনও কষ্ট পান। দুঃখে ভারি হয়ে ওঠে তার মন।
রজব আলীর একটাই প্রত্যাশা, আমি শুধু বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সামনে যেতে চাই, তার সঙ্গে দেখা করতে চাই, বলতে চাই আমার হাতে বঙ্গবন্ধুর বুকের ছোঁয়া রয়েছে।