প্রশান্তি ডেক্স॥ একটি ফাউন্ড্রি কারখানায় কমরত এক শ্রমিক, এই খাতের ন্যূনতম মজুরি সর্বশেষ নির্ধারণ করা হয় ১৯৮৩ সালে দেশের ৪২টি শিল্পখাতের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে থাকে সরকার। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় ৫ বছর পরপর এসব খাতের মজুরি পুনর্নিধারণের কথা। কিন্তু দেখা গেছে, ৫ বছর পেরিয়ে বহুদিন গেলেও ১৯টি খাতের ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো হয়নি। এমনকি কোনো কোনো খাতে সর্বশেষ ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের ৩৬ বছর পেরিয়ে গেলেও তা আর পুনর্নিধারণ করতে পারেনি নিম্নতম মজুরি বোর্ড। মালিকদের অসহযোগিতার কারণেই মূলত দীর্ঘদিনেও ন্যূনতম মজুরি পুনর্নিধারণ করা যায়নি বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। বিভিন্ন খাতের শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিতে বাজারমূল্য বিশ্লেষণ করে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে দেয় সরকার। সংশ্লিষ্ট খাতের মালিকরা এই মজুরির নিচে কোনো শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণ করতে পারেন না। ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের দায়িত্ব নিম্নতম মজুরি বোডের। এ বোডের চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন সিনিয়র জেলা জজ খোন্দকার হাসান মো. ফিরোজ। এছাড়া নিরপেক্ষ সদস্য হিসেবে রয়েছেন ড. মো. কামাল উদ্দীন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের অধ্যাপক ও কোষাধ্যক্ষ), মালিকদের প্রতিনিধিত্বকারী সদস্য কাজী সাইফুদ্দিন আহমদ (বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের শ্রম উপদেষ্টা) ও শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বকারী সদস্য হিসেবে রয়েছেন ফজলুল হক মন্টু (জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি)। এই চারজন বোডের স্থায়ী সদস্য। যে খাতের মজুরি নির্ধারিত হয় সেই শিল্পের মালিকদের প্রতিনিধিত্বকারী একজন ও শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বকারী একজন সদস্য বোর্ডে যুক্ত হন। ন্যূনতম মজুরির মেয়াদ (৫ বছর পূর্ণ) শেষ হলে শ্রম অধিদফতর থেকে সংশ্লিষ্ট থাতের মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধি নির্ধারণ করে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায়। মন্ত্রণালয় তখন বোর্ড গঠন করে গেজেট জারি করে। তখন নিম্নতম মজুরি বোর্ড মজুরি নির্ধারণে পদক্ষেপ নেয়। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, মজুরি বাড়ানোর বিষয় থাকে বলে মালিকরা সহজে প্রতিনিধি দিতে চান না। কেউ মালিক প্রতিনিধি হতেও চান না। আবার শ্রমিকদের মধ্যেও দলাদলির কারণে তারা অনেক সময় একমত হতে পারেন না। তাই সময় মতো মজুরি নির্ধারণ করা যায় না। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, ৫ বছর পার হওয়া শিল্প সেক্টরের মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধির নামের প্রস্তাব শ্রম অধিদফতর থেকে পাওয়া-সাপেক্ষে মজুরি পুনর্র্নিধারণের কার্যক্রম শুরু হবে। মালিক প্রতিনিধির মনোনয়ন পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনকে, শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধির নামের প্রস্তাব প্রেরণের জন্য জাতীয় শ্রমিক লীগকে এবং বিভাগীয় শ্রম দফতর ও আঞ্চলিক শ্রম দফতরে তাগিদপত্র পাঠানো হয়েছে। নূন্নতম মজুরি বোডের চেয়ারম্যান খোন্দকার হাসান মো. ফিরোজ জাগো নিউজকে বলেন, ‘মেয়াদ পার হওয়া খাতগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি খাতের মজুরি নির্ধারণের কাজ চলছে। কয়েকটির সুপারিশ চূড়ান্ত হয়েছে, কয়েকদিনের মধ্যেই গেজেট জারি হবে। আরও কিছু প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। যেগুলোর প্রস্তাব আমাদের কাছে আসেনি, সেগুলো তো আমরা নির্ধারণ করতে পারি না।’ যেসব খাতের মজুরি নির্ধারণ করা হয় নূূনতম মজুরি বোর্ড টাইপ ফাউন্ড্রি, পেট্রোল পাম্প, আযুুর্বেদিক কারখানা, আয়রন ফাউন্ড্রি অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওযয়ার্কশপ, টি-গার্ডেন, ব্যক্তিমালিকানাধীন সড়ক পরিবহন, অয়েল মিলস অ্যান্ড ভেজিটেবল প্রোডাক্টস, প্রিন্টিং প্রেস, রি-রোলিং মিলস, হোমিওপ্যাথ কারখানা, সল্ট ক্র্যাশিং, রাইস মিল, প্লাস্টিক, নির্মাণ ও কাঠ, কোল্ডস্টোরেজ এবং কৃষি ও গৃহকর্মে নিয়োজিত শ্রমিক ছাড়া বাংলাদেশের সব ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহে নিয়োজিত অদক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক ও তরুণ শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণ করে। এছাড়া ব্যক্তিমালিকানাধীন পাটকল, রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ, সিনেমা হল, চামড়াজাত পণ্য ও জুতা কারখানা, ম্যাচ ইন্ডাস্ট্রিজ, জুট প্রেস অ্যান্ড বেলিং, স-মিলস, চিংড়ি, মৎস্য শিকারি ও ট্রলার, বিড়ি, বাংলাদেশের স্থলবন্দর, হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, হোসিয়ারি, সোপ অ্যান্ড কসমেটিক্স, ফার্মাসিউটিক্যাল, টি-প্যাকেটিং, জাহাজভাঙা, ট্যানারি, দর্জি কারখানা, কটন টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ, বেকারি-বিস্কুট ও কনফেকশনারি, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ, অ্যালুমিনিয়াম অ্যান্ড এনামেল, গার্মেন্টস, গ্লাস অ্যান্ড সিলিকেট এবং সিকিউরিটি সার্ভিস খাতের মজুরিও নির্ধারণের দায়িত্ব বোডের হাতে। যে ১৯ খাতের মজুরি নির্ধারণের সময় ৫ বছর পেরিয়েছে ৪২টি খাতের মধ্যে টাইপ ফাউন্ড্রি খাতের ন্যূনতম মজুরি সর্বশেষ নির্ধারণ করা হয় ১৯৮৩ সালের ৭ আগস্ট। তখন ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয় ৫২১ টাকা। ৩৬ বছর পার হলেও এখাতে ন্যূনতম মজুরি আর বাড়েনি। পেট্রোল পাম্প খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয় ১৯৮৭ সালের ৩০ নভেম্বর। তখন নির্ধারণ করা ৭৯২ টাকা ন্যূনতম মজুরি এখনো বহাল রয়েছে। এছাড়া ২০০৯ সালের ৩ ডিসেম্বর আয়ুর্বেদিক কারখানার ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়। ১০ বছর পেরোলেও এখনো ন্যূনতম মজুরি ৪ হাজার ৩৫০ টাকাই আছে। সর্বশেষ ২০১০ সালের ১৪ জুলাই আয়রন ফাউন্ড্রি অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, ২০১০ সালে টি-গার্ডেন, ২০১০ সালে ব্যক্তিমালিকানাধীন সড়ক পরিবহন, ২০১০ সালের ১ জুলাই ওয়েল মিলস অ্যান্ড ভেজিটেবল প্রোডাক্টস, ২০১১ সালের ২২ মে হোমিওপ্যাথ কারখানা, ২০১১ সালের ১ মে সল্ট ক্র্যাশিং, ২০১২ সালের ৮ অক্টোবর মির্মাণ ও কাঠ, ২০১২ সালের ১১ অক্টোবর কোল্ড স্টোরেজ খাতের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়। কৃষি ও গৃহকর্মে নিয়োজিত শ্রমিক ছাড়া বাংলাদেশের সকল ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহে নিয়োজিত অদক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক ও তরুণ শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণ করা হয় ২০১২ সালের ৫ ডিসেম্বর। ২০১৩ সালের ৩ জানুয়ারি রাবার ইন্ড্রাস্ট্রি, ২০১৩ সালের ২২ আগস্ট সিনেমা হল, ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ম্যাচ ইন্ডাস্ট্রিজ, ২০১৩ সালে ব্যক্তিমালিকানাধীন পাটকল, ২০১৩ সালে চামড়ার পণ্য ও জুতা কারখানা, ২০১৪ সালের ১৭ জুন জুট প্রেস অ্যান্ড বেলিং এবং ২০১৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর স-মিল খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়। নিম্নতম মজুরি বোডের সচিব রাইসা আফরোজ বলেন, ‘পাঁচটি সেক্টরের ন্যূনতম মজুরি চূড়ান্ত করে সুপারিশ আকারে ইতোমধ্যে শ্রম কর্মসংস্থার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। খাতগুলো হল- ব্যক্তিমালিকানাধীন সড়ক, রাইস মিল, প্লাস্টিক, রি-রোলিং ও জুতা এবং চামড়াজাত পণ্য।’ তিনি জানান, চা বাগান, প্রিন্টিং প্রেস ও সিকিউরিটি সার্ভিস খাতের মজুরি নির্ধারণের কার্যক্রম বোর্ডে চলমান রয়েছে। নিম্নতম মজুরি বোডের সদস্য কাজী সাইফুদ্দিন আহমদ বলেন, ‘কোন কোন খাতের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের সময় ৫ বছর পেরিয়ে গেছে, সেগুলোর তালিকা করা হয়েছে। মুশকিল হলো মালিক ও শ্রমিকদের প্রতিনিধি পাওয়া যায় না। মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধি ছাড়া তো সরকার মজুরি বোর্ড গঠন করতে পারে না। এজন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেরি হয়ে যায়।’ তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু সেক্টর রয়েছে যেগুলোর সেভাবে অস্তিত্ব নেই। এসব খাত ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের তালিকা থেকে বাদ দেয়া উচিত বলে আমি মনে করি।’
Share on Facebook
Follow on Facebook
Add to Google+
Connect on Linked in
Subscribe by Email
Print This Post