প্রশান্তি ডেক্স \ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ ঠেকাতে দেশে দেশে চলছে লকডাউন। এই অবরুদ্ধ অবস্থা মানুষের মানসিক বা মনস্তাত্তি¡ক দিকে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। গুরুতর হচ্ছে মানসিক সমস্যা। বাড়ছে মন খারাপ, অনিদ্রা, উদ্বেগ-উত্তেজনা, উৎকণ্ঠা, বিভ্রান্তি, বিষণ্নতা, রাগ, খিটখিটে মেজাজ, অবসাদ আর বিপর্যয় বা ট্রমা-পরবর্তী মানসিক চাপ। সব দেশেই দেখা যাচ্ছে ভাইরাসটির শারীরিক ঝুঁকির সামলাতে ব্যতিব্যস্ত সরকার। করোনা পরবর্তীতে মানসিক বা মনস্তাত্তি¡ক দিকে রাষ্ট্রগুলোর উদাসিনতার চড়া দাম দিতে হবে। করোনাভাইরাসের কারণে পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এখন লকডাউনে বা ঘরবন্দী। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডবিøউইএফ) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ বলছে, এই মানুষদের গুরুতর মানসিক সমস্যা হচ্ছে। স্বাস্থ্যঝুঁকির এ দিকটি করোনাসৃষ্ট অর্থনীতির বিপদকে আরও বাড়াবে। দেশের কয়েকজন মনোবিদ আর অর্থনীতিবিদের সঙ্গে কথা বলেও এই সমস্যার আলামত পাওয়া গেল। বেলজিয়ামের মনোবিদ এলকে ভ্যান হুফ ওই নিবন্ধে ঘরবন্দী মানুষদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়াকে বিশেষ গুরুৃত্ব দিয়েছেন। বিশ্বে লকডাউনে থাকা মানুষের সংখ্যা ২৬০ কোটি। ঘরবন্দী মানুষের সংখ্যার দিক থেকে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। ভ্যান হুফ এ অবস্থাকে এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় মনস্তাত্তি¡ক পরীক্ষা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আন্তর্জাতিক চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট–এ ২৬ ফেব্রæয়ারি প্রকাশিত একটি নিবন্ধের বরাত দিয়ে তিনি লিখেছেন, গৃহবন্দী মানুষেরা নানা রকম মানসিক চাপ ও অসুস্থতার শিকার হয়ে থাকে। এর মধ্যে আছে মন খারাপ, অনিদ্রা, উদ্বেগ-উত্তেজনা, উৎকণ্ঠা, বিভ্রান্তি, বিষণ্নতা, রাগ, খিটখিটে মেজাজ, অবসাদ আর বিপর্যয় বা ট্রমা-পরবর্তী মানসিক চাপের নানা লক্ষণ। এলকে লিখছেন, চীনে লকডাউন-সম্পর্কিত প্রাথমিক গবেষণাপত্রগুলোতে তেমন সমস্যার চিত্র উঠে আসছে। ল্যানসেট–এর নিবন্ধটি বিভিন্ন কোয়ারেন্টিনকালীন ২৪টি গবেষণাপত্রের পর্যালোচনা। এগুলোর মধ্যে হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর একটি গবেষণার কথা আছে। তাতে দেখা যায়, সঙ্গনিরোধের তিন বছর পরও প্রায় ১০ শতাংশ কর্মীর উচ্চ বিষণ্নতার লক্ষণ ছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এরই মধ্যে করোনায় আক্রান্ত দেশগুলোর জন্য মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক নির্দেশনা তৈরি করছে। এদিকে উহানের হাসপাতালে আসা রোগীদের একটি গোষ্ঠীর মধ্যে পরিচালিত গবেষণার একটি অপ্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, ৩৪ শতাংশের বেশি রোগীর মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং ২৮ শতাংশের মধ্যে বিষণ্নতা দেখা গিয়েছে। উহানের কেন্দ্রীয় বিবাহ নিবন্ধন বিভাগের হিসাবে প্রদেশটিতে বিবাহবিচ্ছেদের হার ২৫ শতাংশ বেড়েছে। প্রতিদিনই বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন নিয়ে নাগরিকেরা আসছেন। ভ্যান হুফ বলছেন, কোভিড-১৯ রোগের শারীরিক স্বাস্থ্যঝুঁকি সামাল দিতে রাষ্ট্রগুলো যত ব্যবস্থা নিচ্ছে, মানসিক বা মনস্তাত্তি¡ক সহায়তার বিষয়টি ততটা মনোযোগ পাচ্ছে না। লকডাউন উঠে যাওয়ার তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে যখন সুস্থ-সমর্থ সব মানুষের সহায়তা লাগবে, তখন এই অবহেলার দাম দিতে হবে। লকডাউনে দেশে প্রভাব ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় অনেকেই নিজেদের ভয়, আতঙ্ক, উদ্বাগ, হতাশা আর বিষণ্নতার কথা লিখছেন। একজন যেমন লিখেছেন, ‘আর কয়দিন বাসায় থাকলে পাগল হয়ে যাব।’ আরেকজন লিখেছেন, ‘ডাই অর ডাই’ অর্থাৎ মৃত্যু অথবা মৃত্যু। ঢাকার অনেক মনোবিদ এখন টেলিফোনে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চিকিৎসা পরামর্শ দিচ্ছেন। একজন মনোবিদকে এক রোগী লিখেছেন, ‘নিয়মিত ঘুমের ওষুধ খেয়েও রাতে দুই–তিন ঘণ্টার বেশি ঘুম আসছে না। সব সময় মৃত্যু ভয় কাজ করছে।’ আরেকজন লিখেছেন, ‘টেলিভিশন না খুললে, পরিস্থিতি সম্পর্কে জানা যাচ্ছে না। আবার টিভি সংবাদে করোনায় মৃত্যু সংবাদগুলো দেখে মনে অশান্তি, ভয় ও আতঙ্ক বাড়ছে।’ মনোবিদরা বলছেন, তারা এতদিন বিষণ্নতা ও মাদকাসক্ত রোগী বেশি পেতেন। এখন অস্থিরতা, অনিদ্রা ও মৃত্যুভয়ের মতো নানা সমস্যার রোগী পাচ্ছেন। মহামারির সময় মানুষের মানসিক সমস্যা বেড়ে যায় জানিয়ে তারা বলছেন, মহামারির কারণে তখন অমানবিক ও অযৌক্তিক আচরণ বেড়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের উচিত করোনার চিকিৎসাসেবায় মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করা। এ দেশে সেটাই হবে প্রথম করণীয়।
Share on Facebook
Follow on Facebook
Add to Google+
Connect on Linked in
Subscribe by Email
Print This Post