প্রশান্তি ডেক্স ॥ ছেলে ও তিন বছরের মেয়েকে দূরে সরিয়ে রেখে মহামারি করোনা মোকাবিলায় মাঠে নেমেছেন নারায়ণগঞ্জের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তানিয়া তাবাসসুম। সন্তান ও পরিবারের ভালোবাসা ভুলে দেশ ও জাতির জন্য যুদ্ধে নেমেছেন তিনি। করোনা যুদ্ধে নামার আগে দুই শিশুসন্তানকে ঢাকায় মায়ের কাছে রেখে আসেন এই ম্যাজিস্ট্রেট। দায়িত্ব পালন ও মানুষকে সচেতন করতে গিয়ে অজান্তেই করোনায় আক্রান্ত হন তিনি। একই সঙ্গে তার স্বামী ও মা করোনায় আক্রান্ত হন। এরপরও ভেঙে পড়েননি থেমে যাননি তিনি। মনোবল দৃঢ় রেখে এখনও করোনা যুদ্ধে লড়ছেন ম্যাজিস্ট্রেট তানিয়া। নারায়ণগঞ্জে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে করোনা। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। ইতোমধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন জেলা প্রশাসনের দুই ম্যাজিস্ট্রেট, মারা গেছেন ত্রাণ শাখার এক কর্মচারী। আক্রান্তদের একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তানিয়া। করোনার সংক্রমণ এড়াতে সবাইকে ঘরে ফেরাতে মাঠে থেকে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। একই সঙ্গে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষের ঘরে ঘরে ত্রাণ পৌঁছে দিয়েছেন। দায়িত্ব পালন অবস্থায় করোনায় আক্রান্ত হন তানিয়া। করোনা পজিটিভ আসার পর আইসোলেশনে চলে যান তিনি। এরই মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে এক সপ্তাহ বাড়িতে আইসোলেশনে থেকে চিকিৎসাসেবা নিয়ে সোমবার (২০ এপ্রিল) সুস্থ হয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন ইমতিয়াজ উদ্দিন। একই দিন রাতে আইসোলেশনে থেকে নিজের ফেসবুকে কোভিড-১৯ যুদ্ধ ও জনসেবায় প্রশাসন শীর্ষক একটি স্ট্যাটাস দেন করোনায় আক্রান্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তানিয়া। তার স্ট্যাটাসটি ভাইরাল হয়ে যায়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তানিয়া তাবাসসুম স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘কোভিড ১৯ যুদ্ধ ও জনসেবায় প্রশাসন। করোনার ভয়াল থাবা এসে পড়তে দেরি নেই, সবাই প্রস্তুত হও, সরকারের নির্দেশ। সরকারের কর্মচারী তাই পিছপা হওয়ার সুযোগ নেই। দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ প্রশাসনের চাকরির ধর্ম। এক বছরের তাইফ আর তিন বছরের নামিরাকে মায়ের কাছে ঢাকায় রেখে নারায়ণগঞ্জে থাকতে শুরু করলাম। নিয়মিত অফিস, মোবাইল কোর্ট, গণসচেতনতা কার্যক্রম, জরুরি ত্রাণ সরবরাহ, কন্ট্রোল রুম ডিউটি, প্রতিদিনের রিপোর্টসহ প্রেস ব্রিফিং তৈরি, বেসরকারি ত্রাণ সংগ্রহ কার্যক্রম। যখন যেটা সামনে পড়েছে সবই করেছি।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘ভাবছেন এত বলছি কেন, এসব তো প্রশাসনের কাজই। হ্যাঁ, সেজন্যই ফটোসেশন, ফেসবুক পোস্ট বাহুল্য এড়িয়ে চলেছি। আমি খুব নিভৃতচারী; তাই আগে কাজকে প্রাধান্য দিয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের ছাত্রী ছিলাম বলে জীবাণু নিয়ে কিছুটা অভিজ্ঞতা রাখি। জীবাণু ভীতিটাও তাই সরিয়ে রেখে কাজ করতে পেরেছি বোধ হয়। সারাদিনের চেষ্টা ক্লান্তি শেষে যখন দেখতাম লোকজন কথা শুনছে না, একই ব্যক্তি নানা অজুহাতে ঘরের বাইরে আসছে, ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ে ত্রাণ চাইছে আর প্রশাসনের সব কাজ নিয়েই, যত দোষ নন্দ ঘোষ অপপ্রচার; তখন শুধু নতুন উদ্যম খুঁজে বেড়াতাম। ম্যাজিস্ট্রেট তানিয়া তাবাসসুম আরও লিখেছেন, ‘খারাপ লাগা ঘিরে ধরত যখন ভিডিও কলে সন্তানের মুখ আর প্রিয় স্বরগুলো শুনতে পেতাম। নিজের চেয়ে বেশি ভাবতাম পরিবার নিয়ে। জানেন, কত রাত ঘুমাতে পারিনি। শারীরিক মানসিকভাবে কিছুটা দুর্বলও হয়ে পড়েছিলাম। তার মধ্যে সারা দেশে রব উঠল প্রশাসন বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন নাকি পিপিই চোর। অথচ ডিসি নিজ উদ্যোগে আমাদের সেটা জোগাড় করে দিয়েছিলেন। পরে যত বেসরকারি পিপিই পাওয়া গিয়েছিল; চিকিৎসকসহ অন্য সবাইকে দেয়া হয়েছিল।’ তিনি লিখেছেন, ‘যাইহোক ন্যূনতম নিরাপত্তাটুকু নিয়েই কাজ চালিয়ে গেছি। প্রশাসনের সব যোদ্ধারা সারা দেশে তাই করেছেন। মুসলমান হিসেবে মৃত্যু ভয় মনে রাখিনি।প্রিয় নারায়ণগঞ্জবাসীর প্রাণ বাঁচাতেই দৌড়ে বেড়িয়েছি। নিজ জেলা চাঁদপুর। কিন্তু কর্মস্থল দেশের সমৃদ্ধ একটি জেলা নারায়ণগঞ্জকে আজকে যখন লোকে বাংলাদেশের উহান বলছেন; তখন বুকটা মুচড়ে ওঠে। আপনাদের সেবা করতে গিয়ে আজ জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী আক্রান্ত। মারা গেছেন ত্রাণ শাখার একজন পরিশ্রমী কর্মচারী। এখনও মনে পড়ছে শেষ যেদিন সন্ধ্যায় কাশিপুর, গোগনগর এলাকায় মোবাইল কোর্ট চালিয়েছিলাম। মাইকে চিৎকার করে বলছিলাম প্রিয় নারায়ণগঞ্জবাসী, এ জেলার অবস্থা আর কত খারাপ হলে আপনারা সচেতন হবেন।’ ম্যাজিস্ট্রেট তানিয়া লিখেছেন, ‘আজ আমি, আমার পরিবার (স্বামী, মা), প্রশাসন পরিবার করোনায় আক্রান্ত। আমাদের করোনা রিপোর্ট পজিটিভ আসার পর আত্মীয়, বন্ধু, বিশেষ করে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন আমাকে যেভাবে সাহস জুগিয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে; এই যাত্রায় বেঁচে গেলে- আল্লাহ যেন দ্রুত আবার সুস্থ করে দেন, দেশের সেবা করার তৌফিক দেন। তাদের সবার নাম বলতে গেলে তালিকা দীর্ঘ হয়ে পোস্টটি আরও বড় হয়ে যাবে।’সবশেষে ম্যাজিস্ট্রেট তানিয়া লিখেছেন, ‘সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ভালো থাকুক নারায়ণগঞ্জ, ভালো থাকুক প্রিয় দেশ। সবাই আমার ও পরিবারের জন্য দোয়া করবেন। এই জীবনে বহু ঘাত প্রতিঘাত পার করেছি। সন্তান দুটো জন্ম দিতে গিয়ে দু’দুবার মৃত্যুর মুখ থেকে আল্লাাহ ফিরিয়ে দিয়েছেন। আবার যেন আমরা প্রিয় মুখগুলোর কাছে ফিরতে পারি, আল্লাহ যেন সবাইকে তার রহমতের ছায়ায় রাখেন।’
Share on Facebook
Follow on Facebook
Add to Google+
Connect on Linked in
Subscribe by Email
Print This Post