প্রশান্তি আন্তর্জাতিক ডেক্স ॥ ভারত ও নেপালের সীমান্ত এলাকায় ভারতের সদ্য তৈরি একটি পাহাড়ি রাস্তাকে কেন্দ্র করে অকস্মাৎ দুৎ দেশের সংঘাত চরমে পৌঁছেছে। দিন কয়েক আগে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী সীমান্তের লিপুলেখ এলাকায় একটি লিঙ্ক রোডের উদ্বোধন করেন। নেপাল এর তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং ওই এলাকাটিকে তাদের বলে দাবি করে। তবে ভারত বলছে, নতুন ওই রাস্তকাটি সম্পূর্ণভাবে তাদের ভূ-খন্ডেই নির্মিত হয়েছে। নেপালের পার্লামেন্টেও ভারতের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের দাবি ওঠার পর নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত সোমবার কাঠমান্ডুতে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করেন। এরপর তার হাতে নেপাল সরকারের একটি প্রতিবাদ লিপি তুলে দেন। কিন্তু কেন আর কীভাবে এই দুই বন্ধু দেশের মধ্যে হঠাৎ এই তীব্র কূটনৈতিক বিবাদ শুরু হল? ভারতের উত্তরাখন্ড, চীনের তিব্বত আর নেপালের সীমানা যেখানে মিশেছে সেখানে হিমালয়ের একটি গিরিপথের নাম লিপুলেখ। ,ওই গিরিপথের দক্ষিণের ভূখন্ডটি ‘কালাপানি’ নামে পরিচিত। ওই এলাকাটি ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও নেপাল তাদের অংশ বলে দাবি করে থাকে। গত সপ্তাহে লিপুলেখের সঙ্গে সংযোগকারী নতুন একটি ৮০ কিলোমিটার লম্বা পার্বত্য রাস্তার উদ্বোধন করেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। এরপরই এর বিরুদ্ধে নেপালের পার্লামেন্টে ঝড় বয়ে যায়। পার্লামেন্টে নেপালি কংগ্রেসের এমপি পুষ্পা ভূষল গৌতম বলেন, ‘১৮১৬ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও নেপালের মধ্যে স্বাক্ষরিত সাগাউলি চুক্তি অনুসারে ওই এলাকা সম্পূর্ণভাবে নেপালের।’ আর এক পার্লামেন্ট সদস্য গগন থাপা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘নেপালের এক ইঞ্চি জমিও কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। ভারতের এই দাদাগিরির বিরুদ্ধে নেপালের সিংহভাগ মানুষ গর্জে উঠবে।’ অবশ্য নেপালের সদ্ভাবনা পার্টির এমপি সরিতা গিরি প্রশ্ন তোলেন, ‘এই ইস্যুতে ভারতকে ডিপ্লোম্যাটিক নোট পাঠানো হলেও চীনের বিরুদ্ধেও কেন একই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না?’ পার্লামেন্টে নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রদীপ গাওয়ালি জানান, ২০১৫ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের পরই ওই দুই দেশ লিপুলেখে একটি বাণিজ্যিক পোস্ট খুলতে সম্মত হয়, যা নেপাল কখনওই মেনে নিতে পারেনি। এরপরই তার মন্ত্রণালয় ভারতের তৈরি নতুন রাস্তার তীব্র নিন্দা করে দীর্ঘ বিবৃতি দেয় এবং ভারতের রাষ্ট্রদূত বিনয় মোহন কাটরাকে সিংদরবারে তলব করা হয়। নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রতিফলন? কেন নেপাল এত কঠোর পদক্ষেপ নিল, সে প্রশ্নের জবাবে দিল্লিতে সিনিয়র কূটনৈতিক সংবাদদাতা দেবীরূপা মিত্র বিবিসিকে বলছিলেন, ‘সে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিই এর পেছনে আছে বলে আমার ধারণা। প্রধানমন্ত্রী কে পি ওলি ক্ষমতায় এসেছেন ভারত-বিরোধী প্রচারণাকে হাতিয়ার করে। তার পক্ষে এখানে নরম অবস্থান নেওয়া সম্ভবই নয়। কমিউনিস্ট পার্টিতেও প্রচন্ডর সঙ্গে তার তীব্র ক্ষমতার লড়াই চলছে, সেটাও দেখতে হবে।’ দেবীরূপা মিত্র আরও বলেন, ‘তবে আমাকে যেটা অবাক করেছে তা হল পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠিয়ে তার হাতে নোট তুলে দিয়েছেন। যে কাজটা তিনি সচিবকে দিয়েও করাতে পারতেন।’ কালাপানির ওপর ভারতের দাবির ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে বলে মনে করেন নেপালে নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রদূত দেব মুখার্জি। তবে রাস্তা উদ্বোধনের বিষয়টা অন্যভাবে করা যেতে পারত বলেও তার অভিমত। কালাপানিতে ভারতের দাবি দেব মুখার্জি বিবিসিকে বলছিলেন, ‘শুধু মানচিত্রই নয়, ১৮৪০ থেকে ১৮৬০-র দশকেও আমরা ইংরেজ শিকারি, পর্যটক বা অ্যাডভেঞ্চারারদের অসংখ্য বিবরণ পাই, যেখানে তারা লিপু পেরিয়ে ওই এলাকায় যাচ্ছেন। এটাই প্রমাণ করে কালাপানি ভারতের নিয়ন্ত্রণে ছিল। কারণ নেপাল তখন বিদেশিদের ঢুকতেই দিত না।’ ‘১৯০৬ সালে আলমোয়ার ডেপুটি কমিশনার সি এ শেরিংয়ের বইয়েও ওই এলাকাটিতে ভারতের শাসন ও নিয়ন্ত্রণের স্পষ্ট প্রমাণ আছে।’ তবে তিনি মনে করেন, ‘ভারত যখন নেপালকে কথা দিয়েছে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে, তখন বলা যায় না এটা আমাদেরই এলাকা – তোমাদের এ নিয়ে কিছু বলার হক নেই।’ গত বছর জম্মু ও কাশ্মীরের প্রশাসনিক পুনর্গঠনের পর ভারত দেশের যে নতুন মানচিত্র প্রকাশ করে, তাতে কালাপানিকে ভারতের মধ্যে দেখানোর প্রতিবাদ জানিয়েছিল নেপাল। সীমান্ত সমস্যার নিরসনে তারা পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকও দাবি করে, যা নানা কারণে শেষ পর্যন্ত হয়নি। কিন্তু নেপাল সরকার ও সে দেশের পার্লামেন্ট এখন কোভিড-১৯ সঙ্কট শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে রাজি নয়। তার আগেই এই বিরোধের একটা মীমাংসা দাবি করছে কাঠমান্ডু।
Share on Facebook
Follow on Facebook
Add to Google+
Connect on Linked in
Subscribe by Email
Print This Post