ভজন শংকর আচার্য্য, কসবা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি ॥ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় জোনাকি আক্তার (২৫) নামে এক প্রসুতি ও তার শিশুর মর্মন্তিক মৃত্যু হয়েছে। গত বুধবার ৬ মে উপজেলার গোপিনাথপুর গ্রীন হেলথ হাসপাতালে এই ঘটনা ঘটে। প্রসুতি ও তার শিশুর মৃত্যুর ঘটনা অর্থের বিনিময়ে ধামাচাপা দেয়ার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও গোপিনাথপুর আলহাজ্ব শাহআলম কলেজের অধ্যক্ষসহ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। তারা মালিক পক্ষের হয়ে সামান্য কিছু টাকা দিয়ে বিদায় করে দেন প্রসুতির পরিবারকে এমনটাই অভিযোগ পরিবারের। স্থানীয়দের অভিযোগ এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভ’ল চিকিৎসায় একাধিক প্রসুতির মৃত্যু হলেও অদৃশ্য কারনে পার পেয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা। খোঁজ নিয়ে জানা যায় , গত ৬ মে ভোর ৪টার দিকে উপজেলার বিনাউটি গ্রামের প্রবাসী ফারুক আহাম্মদের স্ত্রী জোনাকী আক্তারের প্রসব ব্যাথা উঠলে তার বাবার বাড়ী ফতেহপুর থেকে গোপিনাথপুর গ্রীণ হেলথ হাসপাতালে নিয়ে আসে জোনাকির মা সায়েরা বেগম। পরে সকাল ৬টায় জোনাকির শরীরে স্যালাইন পুশ করে আকলিমা নামক কথিত ডাক্তার। তার আগে ওটিতে যাওয়ার আগে জোনাকি সুস্থভাবে ওজু করে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নেয়। অপারেশন থিয়েটারে তার শরীরে ইনজেকশন পুশ করার কিছুক্ষন পরই মৃত্যু হয় বলে ধারনা করছেন তার মা। অপারেশন থিয়েটারে নেয়ার পর ২ ঘণ্টা পর্যন্ত তার মেয়ে ও বাচ্চাকে থিয়েটার থেকে বের না করায় তার মনে সন্দেহ জাগে। যার কাছেই তার মেয়ের অবস্থা জানতে চায় কেউ কোনো কথা বলেনা। ভয় পেয়ে যায় জোনাকির মা। ২ ঘন্টা পর কথিত মহিলা ডাক্তার ওড়না দিয়ে মুখ ডেকে থিয়েটার থেকে বেরিয়ে যায়। হাসপাতালের লোকজনের ছুটাছুটিতে জোনাকির মায়ের সন্দেহ আরো বেড়ে যায়। কিছু জানতে চাইলেই ধমক দেয় হাসপাতালের লোকজন। এই দুই ঘন্টার মধ্যে চলে ধামাচাপা দেয়ার সকল নাটক। নাটকের যবনিকা টানতে হাসপাতালে আসেন ইউপি চেয়ারম্যান এসএম মান্নান জাহাংগীর ও গোপিনাথপুর কলেজের অধ্যক্ষ আকরাম খানসহ কয়েকজন স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। পরে তাদের পক্ষ থেকে জোনাকির মাকে জানানো হয় থিয়েটারে নেয়ার পর ভয়ে জোনাকি এবং তার শিশুটি মারা গেছে। এই খবর শুনে জোনাকির মা বিলাপ করতে করতে অজ্ঞানের মতো হয়ে যান। খবর পেয়ে ছুটে আসেন জোনাকির শ্বশুরবাড়ী ও বাবার বাড়ির লোকজন। পরে চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে ঘটনা ধামাচাপা দিতে মনের মতো করে গল্প বানিয়ে বুঝিয়ে ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা জরিমানা ধার্য করেন হাসাপাতলকে। পরে জোনাকির দাফন-কাফনের জন্য স্বজনদের হাতে নগদ ৩০ হাজার টাকা তুলে দেন হাসপাতাল মালিক পক্ষ। বাকি টাকা পরে বুজিয়ে দেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়। জোনাকির স্বজনরা জানায় হাসপাতালে ভিতরে থাকাবস্থায় জোনকিকে দেখতেও দেয়নি হাসপাতালের লোকজন। প্যাকেট করে জোনাকি ও তার শিশুর মৃতদেহ গাড়িতে তুলে দেয় হাসপাতালের লোকজন। পরে বাড়িতে নিয়ে দেখতে পায় জোনাকিকে সিজার করা হয়েছিলো। তার হাত-পা স্যালাইনের পাইপ দিয়ে বাধা ছিলো। তার শিশুটিরও দুই হাত স্যালাইনের পাইপ দিয়ে বাধা ছিলো। সিজার করতে গিয়ে তার নাড়ি-ভুড়ি কেটে ফেলা হয়েছিলো। এতেই জোনাকি ও শিশুটির মৃত্যু হয়েছে জোনাকির স্বজনদের ধারনা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জানায় এই হাসপাতালে আকলিমা নামে একজন সিনিয়র নার্স আছে। সেই অপারেশন করে থাকে। সে কোনো ডাক্তার নয়। হাসপাতালের ম্যানেজার মো.সোহেল সরকার সাংবাদিকদের জানায়, এ ব্যাপারে তার কিছু বলার নির্দেশনা নেই। সব জানে ইউপি চেয়ারম্যান এসএম মান্নান জাহাঙ্গীর ও গোপিনাথপুর কলেজের অধ্যক্ষ আকরাম খান। পরে তাদের যোগাযোগ করা হলে তারা জানেনা বলে দায় এড়ানোর চেষ্টা করে।
জোানকির মা সায়েরা বেগম বলেন: গ্রীন হেলথ হাসপাতালের কথিত মহিলা ডাক্তার ভ’ল চিকিৎসা করে আমার মেয়ে জোনাকি তার নবজাতক শিশুটিকে মেরে ফেলেছে। সরকারের কাছে এর বিচার চাই যেন আমার মতো আর কোনো মায়েক বুক যেন খালি না হয়। মেয়েকে বিয়ে দেয়ার ৭ বছর পর মা হয়েছিলো। কথিত ডাক্তার আমার মেয়ে ও নাতি দুজনকেই মেরে ফেলেছে। আমার মেয়ে সুস্থ অবস্থায় হাসপাতাল পর্যন্ত গিয়েছে আর ফিরেছে লাশ হয়ে বলেই মেয়ের কাপড় বুকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে। এরা আমার মেয়ের ভর্তির কাগজপত্রগুলো দিয়ে আবার নিয়ে যায়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে গোপিনাথপুর ইউপি চেয়ারম্যান এসএম মান্নান জাহাংগীর ও গোপিনাথপুর শাহআলম কলেজ অধ্যক্ষ আকরাম খান সাংবাদিকদের বলেন; রোগী থিয়েটারে নেয়ার পর ষ্ট্রোক করে মারা গেছে শুনেছি। জরিমানার মাধ্যমে ধামাচাপা দেয়ার বিষয়ে কিছু জানেনা বলে জানান তারা। এদিকে নিহতের মা সায়েরা বেগম ও পরিবারের লোকজন বলছে এদের নেতৃত্বেই জরিমানা করে শেষ করা হয়েছে। এ বিষয়ে কসবা থানা অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ লোকমান হোসেন বলেন; এই মৃত্যুর বিষয়ে কোন পক্ষ থেকেই অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাসুদ উল আলম বলেন; বিষয়টি এক প্রকার হত্যার শামিল। ইউপি চেয়ারম্যান বা অন্য কেউ এর সমাধান দেয়ার অধিকার নেই। এ বিষয়টি পুলিশকে না জানিয়ে জরিমানার মাধ্যমে নিম্পত্তি করা মানে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।