প্রশান্তি ডেক্স ॥ হাফিজ উদ্দীন। পিতা ইয়ারু শেখ। গ্রাম মধুপুর উপজেলার শোলাকুড়ি ইউনিয়নের বারো তীর্থ গ্রামে। পনেরো বছর ধরে ওমান প্রবাসী। পাকা বাড়ী। বিশ বিঘা জমিতে আছে আনারস ও কলা বাগান। হতদরিদ্র তালিকায় তিনি এবার প্রধানমন্ত্রীর নগদ প্রণোদনার ২ হাজার ৫০০ টাকা পেয়েছেন। শুধু হাফিজ উদ্দীন নন, স্থানীয় বড় ব্যবসায়ী, অবস্থাপন্ন গৃহস্থ এবং ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের শ্বশুর, শ্যালক, ভায়রা ভাই, আপন তিন ভাই, মামা, মামাতো ভাই, চাচা, চাচাতো ভাইসহ ৫১ স্বজন এ প্রণোদনার টাকা পেয়েছেন। অথচ ওই ইউনিয়নে বাস করা হতদরিদ্র গারো ও কোচরা বঞ্চিত হয়েছেন এ টাকা থেকে।
মধুপুর উপজেলার শোলাকুড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আখতার হোসেন এবং ৩নং ওয়ার্ডের মেম্বার ফরহাদ আলীর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আনা হয়েছে। টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মো. শহীদুল ইসলাম দৈনিক ইত্তেফাককে জানান, এলাকাবাসী এমন কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলে প্রতিকারের দাবিতে তার নিকট গত সোমবার আবেদন করেছেন। বিষয়টি তদন্ত করে দেখার জন্য মধুপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আরিফা জহুরাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। অভিযোগের সত্যতা মিলবে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মধুপুর উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায় এ উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার ৬ হাজার ১২০টি পরিবার ১ কোটি ৭৩ লক্ষ টাকার নগদ প্রণোদনা পান। এর মধ্যে শোলাকুড়ি ইউনিয়নের ৩৩০ টি পরিবার পায়৮ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা। চেয়ারম্যান আখতার হোসেনের বিরুদ্ধে এ টাকা প্রাপ্তির তালিকা তৈরিতে স্বজনপ্রীতি ও জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়েছে। ওই ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩৩০ টি প্রণোদনার মধ্যে শুধু মাত্র ৯নং ওয়ার্ডে দেয়া হয়েছে ৮৬টি প্রণোদন। যেখানে তার ৫১ জন স্বজনের বসবাস।
ইউনিয়ন পরিষদের তালিকার ১৪০ ও ১৫৪ নম্বরে রয়েছেন আদিল হোসেন ও আলাল উদ্দিন নামে চেয়ারম্যানের দুই সহোদর। ১৯৫ ও ১৬৩ নম্বরে আছে দুই শ্যালক আক্তার ও চান মিয়ার নাম। ১৯৬, ২০৬ ও ১৯৩ নম্বরে আছে শ্যালক পুত্র যথাক্রমে ফরমান আলী, সুপিন ও বিপ্লবের নাম। আপন ভগ্নিপতি হযরত আলীর নাম ২০৯ নম্বরে, ভগ্নিপতির সহোদর একিন আলী আছেন ২১০ নম্বরে। চাচা আব্দুর রহমান হক ও আপন মামা হাসেম আছেন ১৪৮ ও ২২৮ নম্বরে। ওসমান আলী নামের চাচার তিন সন্তান আপন, স্বপন ও আনিছুর তালিকাভুক্ত হয়েছেন যথাক্রমে ১৫৫, ১৮৩ ও ১৮২ নম্বরে। আব্দুল করিম ও কালাম নামের দুই চাচাও আছেন তালিকার ১৩৪ ও ১৩৩ নম্বরে।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, বিএনপি ও জামায়াত নেতা ছাড়াও ধনাঢ্য আরো অনেক লোকজনের নাম দেয়া হয়েছে ওই তালিকায়। যাদের মধ্যে পাকা বাড়ির মালিক, বড় বড় কলা বাগানের চাষি, ১শ থেকে ২শ মন ধান উৎপাদনে সক্ষম চাষিরা রয়েছেন এই তালিকায়। অভিযোগের সাথে দেয়া তালিকার ২২ নম্বরে চেয়ারম্যানের শ্বশুর এছাহাক আলী, ৪৫ নম্বরে ওমান প্রবাসী হাফিজ উদ্দীনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। হাফিজুরের নামের পাশে থাকা মোবাইল নম্বরে ফোন করলে তার স্ত্রী পরিচয় দিয়ে নাছিমা বেগম প্রধানমন্ত্রীর ২ হাজার ৫ শ টাকা পাওয়ার কথা স্বীকার করেন। ৩ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ফরহাদ আলী জানান, চেয়ারম্যানের শ্বশুরসহ স্থানীয় বেশ কয়েকজন ক্ষতিগ্রস্ত কলা চাষীকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তারা এ সময় অসহায় এ জন্য তাদের নাম তালিকা ভুক্ত করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর উপহার ২ হাজার ৫শ টাকা পেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন চেয়ারম্যানের বাল্যবন্ধু তোফাজ্জল হোসেন নামের জনৈক ব্যক্তি। তিনি জানান, তার এক মেয়ে ভিকারুন্নেসায় পড়ে। ছেলে সদ্য প্রকৌশলী ডিগ্রি অর্জন করেছে। চাকরি হয়নি। এ সময়ে ছেলে মেয়ে বাড়িতে। তারও আয় রোজগার নেই। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর ওই উপহারের তালিকায় তিনি পড়েছেন। যা তার অনেক উপকারে লেগেছে।
তবে অভিযোগে প্রদত্ত তালিকায় ৪১ নম্বরে থাকা ট্রাক শ্রমিক সমিতি’র শোলাকুড়ি বাজার শাখার সভাপতি আব্দুস সামাদ জানেন না তার নাম তালিকায় কিভাবে গেলো। তিনি জানান, তার মোবাইলে কোন টাকা পয়সা আসেনি।
অভিযোগকারী শোলাকুড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য আব্দুল আজিজ ও ৩ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সোহেল রানা জানান, প্রকৃত প্রাপ্যদের নাম এ তালিকা স্থান পায়নি। আমরা তালিকায় রাখার জন্য প্রকৃত অসহায়দের কিছু নাম দিয়েছিলাম। তাদের নাম বাদ দেয়া হয়েছে। টাকা পয়সার বিনিময়ে এবং আত্মীয় স্বজনসহ সচ্ছলদের স্থান দেয়া হয়েছে এই তালিকায়।
অভিযোগের বিষয়ে শোলাকুড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আক্তার হোসেন জানান, যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে তালিকা হয়েছে। অনিয়ম দুর্নীতি হয়নি। তিনি জানান, চেয়ারম্যানের গরীব, দরিদ্র অসহায় আত্মীয় স্বজন থাকতে পারবে না এমন নিয়ম নেই। আর তারা রাষ্ট্রীয় এমন সুযোগ সুবিধা পেতে পারেন না, এমন না। তালিকায় তাদের নাম দেয়া অপরাধ হয়নি।
এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক শহীদুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, অভিযোগ পেয়ে মধুপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
মধুপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফা জহুরা জানান, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি)-কে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি কাজ করছে। ৭ কর্ম দিবসের মধ্যে কমিটি তদন্ত রিপোর্ট জমা দিবে। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া হবে।