কৃষি যান্ত্রিকীকরণে সর্ববৃহৎ বিনিয়োগ করছে সরকার…৫৭ হাজার কৃষিযন্ত্র পাবেন কৃষক

বা আ ॥ কৃষিকাজে জমি আবাদে প্রায় শতভাগ যান্ত্রিকীকরণের ছোঁয়া লেগেছে। কিন্তু শস্য রোপণ বা বপন, কর্তন ও মাড়াইয়ের মতো কাজগুলো এখনো সনাতন পদ্ধতিতেই করে থাকেন কৃষক। এসব কাজে ধানের ক্ষেত্রে অতি নগণ্য পরিসরে যন্ত্রের ব্যবহার হলেও অন্য ফসলে তা-ও নেই। এ অবস্থায় শস্যের সব পর্যায়ে যান্ত্রিকীকরণের ছোঁয়া লাগাতে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে সরকার। এর মাধ্যমে আগামী পাঁচ বছরে ৫৭ হাজার কৃষিযন্ত্র দেয়া হবে কৃষককে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ‘কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প-৩’ শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে কৃষি মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ হবে প্রায় ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা। প্রকল্পের মাধ্যমে হাওড় এলাকায় ৭০ শতাংশ ভর্তুকিতে এবং হাওড় ছাড়া অন্য এলাকায় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকিতে কৃষিযন্ত্র ক্রয় করতে পারবেন কৃষক।

প্রকল্পের আওতায় ধান ও গমের জন্য ১৫ হাজার ও ভুট্টার জন্য ৫০০টিসহ মোট সাড়ে ১৫ হাজার কম্বাইন হারভেস্টার দেয়া হবে। এছাড়া ছয় হাজার রিপার ও তিন হাজার রিপার বাইন্ডার, পাঁচ হাজার রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, পাঁচ হাজার সিডার বা বেড প্লান্টার, পাঁচ হাজার পাওয়ার থ্রেসার দেয়া হবে। এছাড়া পাঁচ হাজার মেইজ শেলার, পাঁচ হাজার ড্রায়ার, ১ হাজার ৫০০টি পাওয়ার স্প্রেয়ার, তিন হাজার পটেটো ডিগার, ৫০০টি ক্যারেট ওয়াশার ও দুই হাজার আলুর চিপস তৈরির যন্ত্র কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ করা হবে।

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক শেখ মো. নাজিমউদ্দিন বলেন, কৃষি শ্রমিকের ঘাটতি থাকায় শ্রমের মজুরি বেশি হচ্ছে। এতে কৃষকের উৎপাদন খরচ ও সময় বৃদ্ধি পাচ্ছে, অলাভজনক হচ্ছে কৃষি। তাই কৃষি যান্ত্রিকীকরণে তৃতীয় এ প্রকল্প নেয়া হয়েছে। চাষাবাদে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে উৎপাদন খরচ কমানো ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে এ প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

কৃষি যান্ত্রিকীকরণে এটি এযাবত্কালের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। এর আগে ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০০৯-২০১২ সাল সময়ে খামার যান্ত্রিকীকরণের প্রথম পর্যায়ের প্রকল্পের মাধ্যমে ৩৮ হাজার ৩৩৮টি বিভিন্ন যন্ত্র এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্পের মাধ্যমে ৩৩৯ কোটি টাকা ব্যয়ে জুলাই ২০১৩ থেকে জুন ২০১৯ সালে ২৫ হাজার বিভিন্ন কৃষি যন্ত্র কৃষকদের সরবরাহ করা হয়েছে।

কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনের কাছে পাঠানো প্রস্তাব অনুযায়ী, সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে ৬৪টি জেলার সব উপজেলায় আগামী পাঁচ বছরে নতুন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে এটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া এটি নতুন অগ্রাধিকার প্রকল্পের তালিকায়ও রয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশন সব প্রস্তুতি প্রায় চূড়ান্ত করেছে। এরই মধ্যে কারিগরি কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিছু সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছে। সংশোধন করার পর আগামীতে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) যেকোনো বৈঠকে এটি অনুমোদন হতে পারে।

প্রকল্পের বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, আমরা চাই কৃষি খাত গ্রামীণ অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে যাক। এ খাতটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভূমিকা নিচ্ছে। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে কৃষকের খরচ কমানোর পাশাপাশি কৃষিতে দক্ষতা আনতে যান্ত্রিকীকরণের প্রতি জোর দেয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে, কৃষি ও স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্পগুলো দ্রুত অনুমোদন দিতে হবে। যান্ত্রিকীকরণের এ প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষির আধুনিকায়ন আরো এক ধাপ অগ্রগতি হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নতুন প্রকল্পের আওতায় ৫৭ হাজার ২৫০টি বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি কেনায় খরচ রাখা হয়েছে ২ হাজার ৭১৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, যা মোট প্রকল্প ব্যয়ের প্রায় ৬৮ শতাংশ। এর মধ্যে ধান, গম ও ভুট্টার জন্য সাড়ে ১৫ হাজার কম্বাইন হারভেস্টারে ব্যয় হবে ২ হাজার ৫৭ কোটি টাকা, ৯ হাজার রিপার ও রিপার বাইন্ডার ক্রয়ে ১১৯ কোটি টাকা। রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের মধ্যে রাইডিং টাইপ দুই হাজার এবং ওয়ার্কিং টাইপ তিন হাজার যন্ত্র ক্রয়ে ২২৬ কোটি টাকা ব্যয় হবে। এছাড়া সিডার বা বেড প্লান্টার ক্রয়ে ৫৬ কোটি টাকা, পাওয়ার থ্রেসার ক্রয়ে ৫২ কোটি ২০ লাখ, পাঁচ হাজারটি মেইজ শেলার ক্রয়ে ৩৭ কোটি ৭০ লাখ, পাঁচ হাজারটি ড্রায়ার ক্রয়ে ৮১ কোটি, ১ হাজার ৫০০টি পাওয়ার স্প্রেয়ার ক্রয়ে ২ কোটি ১২ লাখ, ৭৫০টি পাওয়ার উইডার ক্রয়ে ২ কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার, তিন হাজারটি পটেটো ডিগার ক্রয়ে ৩৭ কোটি ৪০ লাখ, দুই হাজারটি আলুর চিপস তৈরির যন্ত্র ক্রয়ে ১৮ কোটি এবং ৫০০টি ক্যারেট ওয়াশার ক্রয়ে ৭ কোটি টাকা ব্যয় হবে।

এছাড়া প্রকল্পের মাধ্যমে ২৮ দিনব্যাপী নয় হাজার গ্রামীণ মেকানিক প্রশিক্ষণ, পাঁচ দিনব্যাপী ১৫ হাজার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ, এক হাজার কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ, ৩০ হাজার যৌথভাবে জমি ব্যবহারকারী কৃষক বা উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ, ১ হাজার ৪৪০ জনকে যন্ত্র উপযোগী ধানের চারা উৎপাদন কৌশল প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। এছাড়া উদ্বুদ্ধকরণ ভ্রমণ ২০০টি, ১৯৭টি কৃষিমেলা, সমন্বিত খামারে ১ হাজার ২৪০ টন বীজ সহায়তা প্রদান করা হবে। এ ছাড়াও রয়েছে ৪৩টি কর্মশালা, ১৮টি প্রশিক্ষণ ভবন ও ডরমিটরি নির্মাণ, একটি কৃষি যন্ত্রপাতি টেস্টিং ও প্রশিক্ষণ সেন্টার সুবিধা বৃদ্ধি, একটি টেস্টিং শেড নির্মাণ এবং ৩০০টি উপকরণ সংরক্ষণাগার নির্মাণ করা হবে।

কৃষকের উৎপাদন খরচ কমানোসহ উৎপাদন বাড়াতে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পটি বড় অবদান রাখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে এসিআই এগ্রিবিজনেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ড. ফা হ আনসারী বণিক বার্তাকে বলেন, ফসলের মৌসুমে এখন ৩৫-৪০ শতাংশ শ্রমিকের সংকট থাকে। শস্য কাটার ক্ষেত্রে কৃষি যন্ত্রপাতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যদি শস্য ক্ষেতে পড়ে থাকে তাহলে ঝরে যাবে, না হয় ইঁদুরে খাবে। সরকার ভর্তুকি দেয়ার কারণে কৃষক পর্যায়ে কম্বাইন হারভেস্টার বা রিপার ব্যবহার শুরু করেছে। কাটা মৌসুমে শ্রমিকের সংকট মোকাবেলা, তরুণদের কৃষিতে ধরে রাখা, কৃষকের খরচ কমানো ও উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে সম্পদশালী করতে যান্ত্রিকীকরণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। যান্ত্রিকীকরণের সবচেয়ে বড় প্রভাবটি পড়বে শহর ও গ্রামের আয়বৈষম্য কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.