সরকারি কর্মচারি নুরজাহান লিবিয়ায় মানবপাচারে জড়িত

প্রশান্তি ডেক্স ॥ লিবিয়ায় মানব পাচার চক্রের অন্যতম হোতা প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ভুক্ত ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের অফিস সহকারী নূরজাহান আক্তার। প্রবাসী কল্যাণে চাকরির সুবাদে তিনি স্বামী আব্দুস সাত্তারকে দিয়ে গড়ে তোলেন রিক্রুটিং এজেন্সি। এভাবে চাকরির আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে মানব পাচার করে আসছিলেন। সম্প্রতি লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশি হত্যাকাণ্ডের পর বিষয়টি সামনে আসে। স্বামীসহ গ্রেপ্তার নূরজাহান এখন কারাগারে। গত মঙ্গলবার [২৩ জুন ২০২০] তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার সৈয়দা জান্নাত আরা বলেন, নূরজাহান বিএমইটিতে আউট সোর্সিংয়ে চাকরি করেন। তিনি স্বামীর নামে রিক্রুটিং এজেন্সি খুলে মানুষকে বিদেশে পাঠাতেন। লিবিয়ায় মানব পাচারের ঘটনায় তাকে ও তার স্বামীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে পল্টন থানায় করা মামলার তদন্ত চলছে।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের পরিচালক (প্রশাসন ও উন্নয়ন) সোয়াইব আহমাদ খান বলেন, নূরজাহান আক্তার অস্থায়ীভিত্তিতে চাকরি করতেন। তার বিরুদ্ধে মানব পাচার আইনে মামলা হয়েছে। ওই মামলায় তিনি গ্রেপ্তারও হয়েছেন। এ কারণে তাকে গতকাল চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, নূরজাহান ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে অস্থায়ীভিত্তিতে চাকরি করলেও অফিসে সময় দিতেন না। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ইমিগ্রেশন শাখায় সারাক্ষণ রিক্রুটিং এজেন্সির ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। বিএমইটির নন গেজেটেড কর্মচারী ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক নূরজাহান আক্তার মানব পাচার করে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। নূরজাহান ও আব্দুস সাত্তার দম্পতির গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার ভাংগুরা থানার খামারগ্রামে। তবে ঢাকার বেইলি রোডে বাস করেন তারা।

লিবিয়ায় অপহরণকারীরা ৩৮ বাংলাদেশির মধ্যে ২৬ জনকে গত ২৮ মে গুলি করে হত্যা করেছে। গুলি লেগে ও মারধরে আহত হয়েছেন আরও ১২ বাংলাদেশি। দেশের একাধিক চক্র মোটা অঙ্কের বেতনের কথা বলে তাদের লিবিয়ায় পাচার করে। পরে সেখানে অপহরণ করে প্রত্যেকের কাছে কমপক্ষে ১০ লাখ টাকা করে মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা। এ দেশে অবস্থানকারী চক্রের সদস্যদের কাছে মুক্তিপণের টাকা পরিশোধের কথা বলে অডিয়ো-ভিডিয়ো রেকর্ড পাঠানো হয় অপহরণ হওয়াদের স্বজনদের কাছে।

এসব ঘটনায় পাচারকারীদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা হয়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ, থানা পুলিশ ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) পৃথক মামলা এবং পৃথক অভিযানে একাধিক আসামি গ্রেপ্তার করে। নুরজাহান ও তার স্বামী আব্দুস সাত্তারের বিরুদ্ধে গত ৫ জুন মানব পাচার আইনে পল্টন থানায় মামলা করেন সিআইডির এসআই রফিকুল ইসলাম। মামলায় আরও ৩৪ জনের নাম উল্লেখসহ অচেনা ৫০-৬০ জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের কেউ কেউ লিবিয়ায় অবস্থান করছে।

এজাহারে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সময়ে মাদারীপুর জেলার জুয়েল, মানিক, মনির, আসাদুল, আয়নাল মোল্লা, জুয়েল-২, সজীব, জাকির হোসেন, ফিরোজ বেপারী, ফিরোজ, ঢাকার শামীম, কিশোরগঞ্জ জেলার আরফান, রহিম, রাজন, শাকিল, আকাশ, সোহাগ, মো. আলী, জানু মিয়া, সজল মিয়া ও সুজন, যশোরের কামরুল, মাগুরার রাকিবুল ও লাল চান্দ, ফরিদপুরের সাজিদ, গোপালগঞ্জের ওমর শেখ, টাঙ্গাইলের তরিকুল ইসলাম এবং চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার বকুল হোসাইনসহ ৩৮ জনকে মোটা অঙ্কের টাকার বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন রুট ব্যবহার করে আসামিরা লিবিয়ায় পাচার করে। বিনিময়ে আসামিরা মোটা অঙ্কের টাকা নেয়। লিবিয়ায় কম বেতনে কঠোর পরিশ্রমের কাজ দেওয়া হয়। পরে লিবিয়া থেকে অবৈধপথে ইতালি পাঠানোর বন্দোবস্ত করে লিবিয়ায় অবস্থানরত এবং এ দেশের আসামিরা। গত এপ্রিলে ভিকটিমদের সে দেশে একত্র করে অচেনা স্থানে আটকে রাখা হয় এ দেশের আসামিদের যোগসাজশে। মে মাসে তাদের নির্যাতন করে দেশে স্বজনদের কাছে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। অপহরণ হওয়াদের নির্যাতন ও আর্তনাদের শব্দ মোবাইল ফোনে রেকর্ড এবং ভিডিয়ো করে স্বজনদের কাছে পাঠায় লিবিয়ায় অবস্থানকারী আসামিরা। একপর্যায়ে গত ২৮ মে ২৬ বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

মামলাটি তদন্ত করছেন সিআইডির এসআই রাশেদ ফজল। তিনি জানান, মামলা রুজু হওয়ার কয়েকদিন পরই নূরজাহান ও তার স্বামীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা এখন কারাগারে আছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.