প্রশান্তি ডেক্স ॥ বহুরূপী প্রতারক রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. শাহেদের আরো অপকর্ম প্রকাশ্যে আসছে। ২০১৬ সালের দিকে উত্তরায় রিজেন্ট ক্লাব গড়ে তোলেন তিনি। এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আসার কথা ছিল নরসিংদীর যুবলীগের সাবেক আলোচিত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়ার। তবে পাপিয়া ওই অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি। এজন্য তার মনোনীত একজন প্রতিনিধি পাঠান। পাপিয়ার পাঠানো ওই তরুণীকে নিয়েই রিজেন্ট ক্লাব উদ্বোধন করেছিলেন শাহেদ। ক্লাবের আড়ালে সেখানে মূলত মদ ও অসামাজিক কর্মকাণ্ডের আসর বসানো হতো। সোমবার একটি দৈনিকের অনুসন্ধানে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
শাহেদের প্রতিষ্ঠানের একাধিক কর্মী জানান, শাহেদের চক্রে পাপিয়াও ছিলেন। এটা ছিল ওপেন সিক্রেট। ঢাকার একটি থ্রি-স্টার হোটেলের প্লাটিনাম মেম্বার সাহেদ। ওই হোটেলের ছাদে একাধিক পার্টিতে শাহেদ আর পাপিয়া উপস্থিত ছিলেন।
একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, নারীদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলেও শাহেদ বাণিজ্য করতেন। এ কাজে তাকে সহায়তা করতেন বনশ্রীকেন্দ্রিক একটি ম্যারেজ মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের এক নারী। মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের যেসব নারী পারিবারিকভাবে কোনো ঝামেলায় থাকতেন তাদের ব্যাপারে শাহেদকে তথ্য দিতেন ওই নারী। এরপর শাহেদ নানা কৌশলে তাদের ব্যবহার করতেন।
রিজেন্টের সাবেক এক কর্মী জানান, একাধিক স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও অনেক নারীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক ছিল সাহেদের। এসব নিয়ে মাঝেমধ্যে টুকটাক ঝামেলায় পড়তেন তিনি। একবার রিজেন্টের হিসাবরক্ষণ শাখার কর্মকর্তা মার্জিয়া আক্তার মুমুকে মারধর করেন সাহেদের স্ত্রী সাদিয়া আরাবি রিম্মি। রিম্মির সন্দেহ ছিল মুমুর সঙ্গে শাহেদের অনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। পরে মুমুকেও বিয়ে করেন শাহেদ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছোট-বড় আর ছিঁচকে সব ধরনের প্রতারণায় যুক্ত ছিলেন শাহেদ। অবৈধ রিকশার লাইসেন্স দিয়ে কামিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। অবৈধ লাইসেন্স দিয়ে প্রতি রিকশাবাবদ এককালীন দুই হাজার টাকা নিতেন শাহেদ। আর মাসে ২০০ টাকা নিতেন। প্রায় পাঁচশ’র ওপর রিকশার অবৈধ লাইসেন্স দিয়েছেন তুরাগ এলাকার হরিরামপুর ইউনিয়ন পরিষদ নাম ব্যবহার করে। প্রতিটি লাইসেন্সে মালিকের নাম দেওয়া রয়েছে মো. শাহেদ। পিতা সিরাজুল। অবৈধ রিকশা নিয়ে ঝামেলা হলে তা দেখভাল করার জন্য আলাদা বাহিনীও তার রয়েছে।
একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, মাদকের বড় সিন্ডিকেটও ছিল শাহেদের। বিশেষ করে উত্তরা ও গাজীপুর এলাকায় মাদক বাণিজ্যের একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। এ কাজে তাকে প্রশাসনের একজন বড় কর্মকর্তা সহায়তা করেন। মাদক নিয়ে কোথাও ঝামেলা তৈরি হলে করে ওই কর্মকর্তাই সব সামলাতেন। এ ছাড়া উত্তরাকেন্দ্রিক একজন কথিত সাংবাদিকও শাহেদের মাদক সিন্ডিকেটে জড়িত ছিলেন।
রিজেন্টের একাধিক কর্মী জানান, প্রশাসনের অনেক অসাধু লোকজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় নানা অপকর্ম করেও পার পেতেন শাহেদ। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন বড় উন্নয়নমূলক কাজে পাথর সরবরাহসহ নানা কাজ বাগিয়ে নেন তিনি। অন্যরা যে রেটে পাথর সরবরাহ করতেন তার চেয়ে অনেক কম রেটে সাপ্লাই দিতেন শাহেদ। এ কারণ হলো- অনেক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পাথর এনে হুমকি-ধমকি আর ভয় দেখিয়ে তাদের টাকা দিতেন না তিনি। বিনা পয়সা পাথর এনে লাখ লাখ টাকা কামিয়েছেন শাহেদ। তাই সৎ ব্যবসায়ীদের তুলনায় অনেক কম রেটে পাথর সরবরাহ করার ‘খ্যাতি’ ছিল তার।

জানা গেছে, শাহেদের মালিকানাধীন রিজেন্ট ক্লাবেও নিয়মিত মদের আসর বসত। মাসোহারা নিয়ে ঝামেলা হওয়ায় ২০১৭ সালে ওই ক্লাবে অভিযান চালায় পুলিশ। সেখান থেকে বিপুল মদ ও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের মধ্যে ছিল শাওন দাস, জহিরুল ইসলাম রনি, মো. সোহান, তানভীর, রিপন ও সোহেল। তবে ওই ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানার তৎকালীন ওসি দেলোয়ার হোসেন বাদী হয়ে মামলা দায়ের করলেও তাতে রহস্যজনক কারণে শাহেদের নাম ছিল না।
শাহেদের প্রতিষ্ঠানের একজন সাবেক সহকর্মী জানান, অবৈধ ওষুধ কারবারেও জড়িত ছিলেন শাহেদ। সাওয়ার ইসলাম অপু নামে একজন এক কাজে তাকে সহায়তা করতেন। রিজেন্টের দুই হাসপাতালের নিচে ফার্মেসির মালিক ওই অপু। অবৈধ ওষুধের কারবার ছাড়াও চিকিৎসা নিয়ে নির্মম বাণিজ্য করত শাহেদ সিন্ডিকেট। গাজীপুর ও টঙ্গী এলাকার বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ধরে রিজেন্টে নিয়ে আসা হতো। এ কাজের জন্য মাসিক চুক্তিতে লোক নিয়োগ করা ছিল তার।
বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী এনে নিয়মিত রিজেন্টে ভর্তি করাতেন জীবন, আবিদ, প্রকাশ, বিকাশসহ কয়েকজন।
রিজেন্ট হাসপাতালের এক সাবেক কর্মী জানান, এখানে আইসিইউ মানসম্পন্ন না হলেও এটা ঘিরেই বড় ধরনের নির্মম বাণিজ্য ছিল শাহেদের। কোনো রোগী মারা গেলেও আইসিইউতে আটকে রেখে স্বজনদের বলা হতো এখনও জীবিত রয়েছেন। বাড়তি টাকা আদায়ের জন্য মৃত রোগীকে জীবিত দেখিয়ে আইসিইউতে রাখা হতো।
জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানের কোনো কোনো কর্মীকেও ফাঁসানোর জন্য মিথ্যা মামলার আশ্রয় নিতেন সাহেদ। পুলিশকে ম্যানেজ করেই ওই মামলায় কয়েকজনকে ফাঁসানো হতো। রিজেন্টের অনেক কর্মী তার মামলা খেয়ে দেশছাড়া হয়েছেন। কেউ কেউ প্রাণভয়ে পালিয়ে বেড়াতেন।