প্রশান্তি ডেক্স ॥ চাকরি দেয়ার আশ্বাসে রাজধানীর প্রগতি সরণির গ ৯৭/১ নম্বর ভবনের চারতলায় নিয়ে এক তরুণীকে (১৮) ধর্ষণের অভিযোগ উঠে গত মাসে। ধর্ষণে সহযোগিতার অভিযোগে গত ২৪ জুলাই শহিদুল হক (৪৫) ও ২৫ জুলাই জাহিদ হাসানকে (৪৫) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপরেই বেরিয়ে আসে মূল অভিযুক্ত আবদুস সাত্তার ওরফে জসিমের ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ডের তথ্য।
জানা গেছে, সহজ-সরল অল্প বয়সী দরিদ্র নারীদের টার্গেট করে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করে আসছিলেন জসিম। তার অন্যতম সহযোগী কথিত স্ত্রী মানসুরা ওরফে ঝুমা। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নারী সংগ্রহের দায়িত্ব ছিল তার। ঝুমার মাধ্যমেই নারীদের চাকরির ভাইভার কথা বলে ডেকে নিয়ে কৌশলে ধর্ষণ করতেন জসিম। কখনো বাসায় ডেকে আবার কখনো একটি সিকিউরিটি কোম্পানির অফিসের কক্ষের মধ্যেই চলত তার এসব কর্মকাণ্ড। সহায়তা করতেন ওই অফিসের দুই কর্মকর্তা শহিদুল হক ও জাহিদ হাসান। ধর্ষণের পর ভুক্তভোগী নারীদের চাকরি দিলেও জনপ্রতি ২ থেকে ১০ হাজার টাকা করে নিতেন জসিম। টাকা না দিলে ব্ল্যাকমেইল করতেন। গত কয়েক বছরে অসংখ্য নারীকে এভাবে ফাঁদে ফেলে জসিম ধর্ষণ করেছেন বলে তথ্য পেয়েছে পুলিশ।
সর্বশেষ গত ১৭ জুলাই জসিমের সিকিউরিটি সার্ভিসেস অফিসে চাকরির জন্যে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয় পটুয়াখালীতে আসা ওই তরুণী।
জানা গেছে, উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর সে চাকরি খুঁজছিল ওই তরুণী। চাকরির উদ্দেশ্যে বাড্ডা হোসেন মার্কেটের পেছনে ময়নারবাগ এলাকায় তার এক পরিচিতের বাসায় আসে। সেখানে জমিমের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। জসিম তাকে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেন। এরপর গত ১৭ জুলাই প্রগতি সরণির গ ৯৭/১ নম্বর ভবনের চারতলার ওই কোম্পানির অফিসে নিয়ে যান। অফিসে নেওয়ার পর দরজা বন্ধ করে মেয়েটিকে ধর্ষণ করেন। এ সময় প্রতিষ্ঠানটির অপারেশন ম্যানেজার শহিদুল হক রুমের দরজা বাইরে থেকে তালা আটকে দেন। ম্যানেজিং ডিরেক্টর জাহিদ হাসানও ধর্ষণে সহায়তা করেন। ওইদিন বেলা আড়াইটার দিকে ধর্ষণের শিকার হওয়া মেয়েটি লজ্জায় কাউকে কিছু না বলে পরিচিতের ওই বাসায় চলে যান।
পরে অন্য একটি অনলাইন শপিংয়ে চাকরি নেন। সেখানে চাকরিরত অবস্থায় মেয়েটি শুধু কাঁদত। সহকর্মীরা কারণ জানতে চাইলে একপর্যায়ে সে তাদের ঘটনা খুলে বলে। এরপর সহকর্মীরা তাকে নিয়ে ২৪ জুলাই রাতে বাড্ডা থানায় গিয়ে ঘটনার বিস্তারিত জানান এবং ধর্ষণের অভিযোগে একটি মামলা করেন। মামলাটি বর্তমানে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত করছে। তবে মূল আসামি জসিম এখনো গ্রেপ্তার হয়নি।
পিবিআই-এর পরিদর্শক এবং তরুণীর করা মামলাটির বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, গত ৮ আগস্ট মামলাটি হাতে পেয়েছি। প্রাথমিক পর্যালোচনা করেছি। জসিমের মোবাইল নম্বরটি পেয়েছি। তার অবস্থান নিশ্চিতের কাজ চলছে। আশা করছি অল্প সময়েই তাকে গ্রেপ্তার করতে পারব।
এদিকে পুলিশ বলছে, জসিমের প্রধান সহযোগী ও কথিত স্ত্রী মানসুরা ওরফে ঝুমার একটি ডায়েরিতেই পাঁচশ’র বেশি চাকরি প্রত্যাশী নারীর তথ্য রয়েছে। পুলিশের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে জসিমকে ধর্ষণে সহায়তাকারীদের নামও। এছাড়া ধর্ষণের শিকার চার নারী তাদের ওপর চলা ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন। তবে তারা সংসার টিকিয়ে রাখার স্বার্থে মামলা করতে রাজি হননি। ভুক্তভোগী এমন অসংখ্য নারী সামাজিক মর্যাদাহানি আর সংসার বাঁচাতে ধর্ষণের শিকার হওয়ার বিষয়টি চেপে গেছেন বলে প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে।
গত ২৪ জুলাই বাড্ডা থানায় ১৮ বছর বয়সী তরুণীর করা মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. মাসুদুর রহমান বলেন, জসিম ভয়ংকর রকমের খারাপ মানুষ। সে অসহায় নারীদের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করত। তার লালসার শিকার হয়েছেন অসংখ্য নারী। তবে লোকলজ্জার ভয়ে কেউ প্রকাশ করেননি। তবে আমাদের অনুসন্ধানের সময় ৪ থেকে ৫ জন নারী ধর্ষণের শিকার হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। লিংক রোডে সিকিউরিটি কোম্পানির একটি কক্ষে আরো কয়েকজন নারীকে ধর্ষণ করে জসিম। তবে পরিবার ও সংসারের কথা চিন্তা করে কেউ মামলা করতে বা সাক্ষী হতে রাজি হননি।
এই পুলিশ কর্মকর্তা আরো বলেন, জসিম তার সহযোগী ঝুমাকে স্ত্রী পরিচয় দিত। তবে আমরা জানতে পেরেছি ঝুমার স্বামী বিদেশে থাকে। সে জসিমের সঙ্গে টঙ্গীর একটি বাসায় লিভ টুগেদার করত। এই ঝুমাই মূলত নারী সংগ্রহ করতো। তার কাছে সবসময় থাকা একটি ডায়েরিতে ৫ শতাধিক নারীর তথ্য রয়েছে, যাদের চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখানো হয়েছে। এছাড়া অসংখ্য নারীকে চাকরি দিয়েছে, যাদের সঙ্গে জসিম অনৈতিক কাজ করেছে। ঝুমাকে গ্রেপ্তার করতে পারলে আরো তথ্য পাওয়া যাবে।
পুলিশের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে জসিমের প্রতারণার নানা বিষয়। তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলপুর থানায়। এলাকায় তাকে আবদুস সাত্তার নামেই সবাই চেনেন। স্ত্রী ও সন্তান গ্রামের বাড়িতেই থাকে। আর জসিম ঝুমাকে নিয়ে থাকেন টঙ্গীর গাজিপুরার ২৭ মার্কেটের পেছনে। ঝুমার আসল নাম মানসুরা। তার স্বামী বিদেশে থাকার সুযোগে জসিমের সঙ্গেই থাকতেন। এক সন্তানও রয়েছে তার। ঝুমা মূলত জসিমের ব্যক্তিগত সহকারীর কাজ করতেন। ঝুমার মোবাইল ফোনের কললিস্ট বিশ্লেষণ করে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি প্রতিদিন জসিমের সঙ্গে গড়ে ২০ থেকে ২৫ বার ফোনে কথা বলতেন এবং শত শত মেসেজ আদান-প্রদান করতেন। ঢাকার বাইরে থেকে অল্পবয়সী নারীদের এনে জসিমের হাতে তুলে দিতেন ঝুমা। পরে জসিম তাদের নানা কৌশলে ধর্ষণ করতেন। তবে এক নারীকে একবারই ধর্ষণ করতেন তিনি। এছাড়া নারীকর্মী সরবরাহ করে বিভিন্ন কোম্পানি থেকে কমিশন নিতেন জসিম ও ঝুমা। দরিদ্র ওইসব নারীকে সংগ্রহ করতে জসিমের আরো অনেক সহযোগী রয়েছে। তাদের বিষয়েও খোঁজ নিচ্ছে পুলিশ।