আলুর মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব গরীবের ভাত-সিঙ্গাড়ায়, চাহিদা বেড়েছে রুটি-কলায়

– 

প্রশান্তি ডেক্স ॥  সারাদেশে প্রায় সকল খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়েছে। সমাজের উচ্চশ্রেণী ও মধ্যবিত্তরা খাদ্যদ্রব্যের দামের ওই উর্ধ্বগতি কোনোভাবে সামাল দিতে পারলেও, হিমশিম খাচ্ছেন সমাজের নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষেরা। আলুসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে রিকশাওয়লাদের দুপুরের আহারে।

রাজধনীর যে সকল ফুটপাতের খাবারের দোকানে মাত্র আট টাকা মূল্যে এক প্লেট ভাত, পাঁচ টাকা মূল্যের এক টুকরো আলু ভর্তা ও ফ্রি মুসরীর ডাল খেয়ে রিকশাওয়ালা ও দিনমজুরদের দুপুর কাটতো, সেখানেও বেড়েছে খাবারের মূল্য। আবার অনেক জায়গায় মূল্য একই থাকলেও কমানো হয়েছে খাবারের পরিমাণ। এতে খাদ্য কষ্টে ভুগছে স্বল্প আয়ের এসকল শ্রমজীবী মানুষ। রাজধানীর ফুটপাতগুলোর বিভিন্ন খাবার দোকান ঘুরে এমন কিছু দৃশ্যই চোখে পড়েছে।

রাজধানীর রমনা থানার অপর পাশে ফুটপাতে ভাত বিক্রেতা লোকমান মিয়া  বলেন, পাশাপাশি অনেকগুলো দোকান থাকায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলেও আমি খাবারের মূল্য বৃদ্ধি করিনি। কারণ এখানে যেসকল দরিদ্র মানুষ খাবার খায়, মূল্য বৃদ্ধি করলে তারা খেতে আসবে না। তবে খাবারের পরিমাণ আগের চাইতে কমিয়েছেন বলে জানান তিনি। তারপরও লোকসান হচ্ছে বলে দাবি করে তিনি বলেন, যে হারে লোকসান হচ্ছে যদি পারতাম দোকান বন্ধ করে গ্রামে চলে যেতাম।

একই স্থানের আরেক দোকানদার আতিক ইসলাম বলেন,‘আলুর মূল্য ৫০ টাকা, পেঁয়াজের মূল্য ৮০ টাকা। মানুষকে একটু ভালো খাবার দিতে হলে মূল্য একটু বৃদ্ধি করতে হবে। তবে এখনো তিনি তার দোকানের খাবারের মূল্য পরিবর্তন করেননি জানিয়ে বলেন, আপাতত পেঁয়াজ ও আলুর ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছি। তবে বেশি দিন এসব পণ্যের মূল্য এরকম থাকলে খাবারের মূল্য বৃদ্ধি করা ছাড়া কোনো উপায় নেই বলে উল্লেখ করেন তিনি।

আলুর মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব গরীবের ভাত-সিঙ্গাড়ায়, চাহিদা বেড়েছে রুটি-কলায়

আরেক দোকানদার এমদাদ বলেন, সবকিছুর মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ভাতের দাম তো আর বৃদ্ধি করলে কাস্টমার খাবে না। তাই পরিমাণে আগের চেয়ে কম দেই। তবে আলু ভর্তা এখন পাঁচ টাকার পরিবর্তে ১০ টাকা রাখি। তিনি আরো বলেন, আগের চেয়ে কাস্টমার কমেছে। অনেক শ্রমিক এখন ভাতের পরিবর্তে রুটি-কলা খেয়ে দুপুর পার করেন বলেও জানান তিনি।

ফকিরাপুলে ভাত ও খিচুড়ির পাশাপাশি সিঙ্গাড়া-সমুচা বিক্রি করেন রহমত মিয়া। রহমত মিয়ার সাথে কথা বলে জানা যায়, পেঁয়াজ ও আলুর দাম বৃদ্ধির কারণে সিঙ্গাড়ার আকার তাকে ছোট করতে হয়েছে এবং সমুচায় আগের চাইতে পেঁয়াজ কম ব্যবহার করছেন তিনি।

দিনাজপুর থেকে জীবিকার সন্ধানে ঢাকায় এসেছিলেন রিকশাচালক কাজল। তিনি নয়া দিগন্তকে জানান,‘আমি কাকরাইলে একটি মেসে থাকি। সকালের ও রাতের খাবারসহ সেখানে থাকতে মাসে তিন হাজার ৮০০ টাকা দিতে হয়। দুপুর বেলা নিয়মিত পুরানা পল্টনের একটি দোকানে খাই। ডিম, আলু ভর্তা ও ১ প্লেট ভাত দিয়েই ৩৩ টাকায় দুপুরের খাবারটা হয়ে যেতো। এখন আলু ভর্তার দাম বাড়াইছে। ভাতের পরিমাণও কমিয়েছে। ফলে এক প্লেট ভাতে এখন আর খাওয়া শেষ হয় না। দুই প্লেট নিতে হয়। তাই এখন ৩৩ টাকার পরিবর্তে খরচ যায় ৪৬ টাকা। খরচ বাড়ছে কিন্তু ইনকাম তো বাড়ে নাই।’

রিকশাচালক আলমাস মিয়া বলেন, আগে ৪০ টাকায় খাবার খেতাম আর মাঝেমধ্যে সিঙ্গাড়া খেতাম। এখন তো ভাত খেলে প্রায় ৬০ টাকা খরচ যায়। তাই মাঝেমধ্যে রুটি-কলা খেয়ে দুপুর কাটিয়ে দেই।

করোনাকালীন সময়ে কর্ম হারানো মানুষ ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি কতটা প্রভাব ফেলেছে জানতে চাইলে সুজন সম্পাদক বদরুল আলম মজুমদার নয়া দিগন্তকে বলেন, এটা নিম্নআয়ের মানুষের জন্য মরার উপর খাড়ার ঘা। এই করোনাকালীন সময়ে অনেক সুবিধাভোগী মানুষ লাভবান হয়েছে কিন্তু আমাদের দেশের নিম্নআয়ের মানুষের জীবনমান আরো নিম্নগামী হয়েছে। স্বাধীনতার পরে আমরা যতটুকু এগিয়েছিলাম এই মুহূর্তে আমরা আবারো তা থেকে অনেকটা পিছিয়ে গিয়েছি।

তিনি আরো বলেন, সরকারের উচিত, কিছু সুবিধাভোগী মানুষকে দুর্নীতির সুযোগ না দিয়ে জনগণের দিকে খেয়াল করা। অন্যথায় দেশের হতদরিদ্র মানুষের খুব শিগগিরই করুণ পরিণতি লক্ষ্য করা যাবে। এতে করে সামাজিক সম্প্রীতি বিনষ্ট হতে পারে বলেও মনে করেন সুজন সম্পাদক।

উল্লেখ্য, গত কয়েক দিন ধরে খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি আলু বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা দরে। পাশাপাশি বৃদ্ধি পেয়েছে অন্যান্য সবজির দামও। এতে দরিদ্র, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের বাজার করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

এ বিষয়ে গত ১৫ অক্টোবর মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২০ ও কৃষির সমসাময়িক বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আলু ব্যবসায়ীরা বর্তমানে প্রতিকেজি আলুতে অন্তত ২০ টাকা লাভ করছেন। এটা একেবারেই অনৈতিক। কেজিপ্রতি খুচরা পর্যায়ে ৩০ টাকা বেঁধে দেয়া হলেও সেটি বাস্তবায়ন কঠিন। তবে আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার কাজ করছে।

এদিকে এ পরিস্থিতিতে তিন পর্যায়ে দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। কেজি প্রতি খুচরা পর্যায়ে ৩০, পাইকারিতে ২৫ ও হিমাগার থেকে ২৩ টাকা। এই দামে আলু বিক্রি না করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। সম্প্রতি কৃষি বিপণন অধিদফতর থেকে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। দেশের সব জেলা প্রশাসককে এই ব্যাপারে চিঠি দেয়া হয়েছে। তারপরও বাজারে আলুর দামে তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published.