শিক্ষা শূন্য বেদেপল্লী, নিয়মে পরিণত বাল্যবিয়ে

প্রশান্তি ডেক্স ॥ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেই সড়কের পাশে কিংবা খোলা জমিতে যাযাবর বা বেদে পল্লীর পরিবারগুলোকে বসবাস করতে দেখা যায়। তবে তাদের কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই। নির্দিষ্ট সময়ের পর পর তাদের স্থান পরিবর্তন করতে হয়। পলিথিন মোড়ানো ছোট ছোট তাঁবুর মতো ঘরগুলোতে তাদের জন্ম বিয়ে মৃত্যু সবই ঘটে। শিক্ষাহীন ও আর্থিক অসচ্ছলতার মধ্য দিয়ে কাটে তাদের জীবন।

এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছুটতে ছুটতেই জীবনের অধিকাংশ সময় কেটে যায় বেদে পল্লীর মানুষগুলোর। এতে বেঁচে থাকার তাগিদে দু-মুঠো খাবার জোগাড় করতে পারলেও শিশুদেরকে শিক্ষিত করার কথা কল্পনাও করেন না তারা। ফলে শিক্ষাতে শূন্য এ পল্লীর বাসিন্দারা।

আবার অল্প বয়সেই সন্তানদের বিয়ে দেওয়া হয়। বাল্যবিয়ে এদের জন্য অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। তবে একই গোত্রের ছেলে-মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়। এর বাইরের কারো সঙ্গেই তাদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। আর বাল্যবিয়ের কারণে সন্তান জন্মদানে এ পল্লীতে মায়েদের মৃত্যু ঝুঁকিও বেশি।

মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্ন-বস্ত্র জোটাতে পারলেও বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা কপালে নেই তাদের। আধুনিকতার এ যুগেও তাদের মধ্যে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগেনি। ছোট ছোট পলিথিন মোড়ানো তাঁবুঘরে থাকলেও উন্নয়নের কথা ভাবনায় আসে না তাদের। একই কারণে তাদের মাঝে শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি। এতে দেশে বিনামূল্যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু থাকলেও বেদে পরিবারগুলো এখনো তা থেকে বঞ্চিত।

সচেতন মহলের ভাষ্যমতে, বেদে পল্লীর মানুষগুলো সত্যিই খুব অসহায়। উপার্জনের লক্ষ্যে ঘর থেকে একদিন বের হতে না পারলে পরদিন তাদের খাবার জোটে না। তাদের প্রতি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। একই সঙ্গে আইন করে তাদেরকে সরকারি যেকোনো ধরনের সুযোগ সুবিধার অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। যেসব এলাকায় বেদেরা বসতি স্থাপন করেছে, সেসব এলাকার জনপ্রতিনিধিরা মানবিক কারণে হলেও তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করতে হবে।

লক্ষ্মীপুরে বসবাসরত বেদে পল্লীর কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মৌসুম অনুযায়ী খাল কিংবা নদীর পাড়ে তারা ক্ষণস্থায়ী বসবাস করে। তাদের জন্ম, মৃত্যু ও বিয়েসহ নানা অনুষ্ঠান এ পল্লীতেই হয়। এখানকার মেয়েরাই বেশি কর্মঠ ও পরিশ্রমী হয়। পেটের দায়ে তারা ভোরে মনোহরী দ্রব্য ও ঝাঁপি নিয়ে গ্রামাঞ্চলে গিয়ে গাড়লি, শিঙ্গা এবং সাপের বিষ নামানোর কাজ করে থাকেন। আবার কেউ কেউ বাসন-কোসনসহ হরেক রকমের জিনিস ফেরি করে বিক্রি করেন।

আর পুরুষরা তাঁবু পাহারাসহ বাচ্চা দেখাশোনার মাধ্যমে সময় পার করেন। দুপুরে ফের নারীরা তাঁবুতে ফিরে রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। পরিবারের খাবারের ব্যবস্থা করতে রোদ-ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে খোলা আকাশের নিচে মাটির চুলাতেই রান্না করতে হয়। বিকেল থেকে পুরুষরা রাত পর্যন্ত গ্রামাঞ্চলের বাজারগুলোতে তাবিজ বিক্রি করে। সারাদিনে পুরুষ ও নারী বেদেরা ১৫০-২০০ টাকা উপার্জন করে।

জীবিকার তাগিদে ক্ষণস্থায়ীভাবে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বসবাস করার কারণে তাদের শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো পৌঁছাচ্ছে না। এতে তাদের সন্তানরা বড় হয় একই পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে। এরমধ্যে অনেকেই বিপদগামী অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে।

সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের ছটকির সাঁকো এলাকায় বেদে পল্লীর জামাল মিয়া পূর্বপশ্চিমকে জানান, তিনি বাবা-মায়ের সঙ্গে কুমিল্লার দাউদকান্দি সড়কের পাশে বেদে পল্লীতে ছিলেন। প্রায় ১০ বছর আগে তের বছর বয়সী আমেনাকে বিয়ে করে তিনি লক্ষ্মীপুর চলে আসেন। ভবানীগঞ্জে আসার আগে তিনি লক্ষ্মীপুরের আরো ১০-১২টি বেদে পল্লীতে ছিলেন। এখন বাবা-মা কারো সঙ্গেই তার কোনো যোগাযোগ নেই। তার নিজের দু’টি সন্তান রয়েছে।

একই পল্লীর রেশমা খাতুন জানান, বেঁচে থাকার তাগিদে সকাল থেকে তাদের জীবনযুদ্ধ শুরু হয়। স্বামী ও বাচ্চাদের নিয়ে খুব কষ্টে পলিথিনের তাঁবুতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। করোনাকালে দু’মুঠো ভাত জোগাড় করা দায় হয়ে পড়েছে। আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে ইচ্ছে থাকলেও কোথাও স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা করতে পারছে না তারা। জাতীয় পরিচয়পত্র ও স্থায়ী ঠিকানা না থাকায় ইচ্ছে থাকলেও বাচ্চাদের লেখাপড়া করানো সম্ভব হচ্ছে না।

লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক অঞ্জন চন্দ্র পাল বলেন, সমাজে পিছিয়ে পড়া এ সম্প্রদায়ের প্রতি সবার সু-দৃষ্টি দেওয়া উচিত। এছাড়া সরকারিভাবে যাযাবরদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.