প্রশান্তি ডেক্স ॥ মোহাম্মদ আলী আকবর। পেশায় তিনি একজন মসজিদের ইমাম ও মসজিদ ভিত্তিক আরবী শিক্ষার শিক্ষক। তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে সারাজীবন ভাড়া বাসায় থাকলেও রাজধানীতে নিজের একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। এরইমধ্যে ‘মাত্র ২২০০ টাকার প্রতিমাসে সহজ কিস্তিতে জমির মালিক’- এমন একটি চটকদার বিজ্ঞাপন নজরে পড়ে তার। দেরি না করে আলী আকবর যোগাযোগ করেন ‘নাসিম রিয়েল এস্টেটে’র সঙ্গে। আর সেই যোগাযোগই কাল হয়ে যায় তার। প্রতারকের খপ্পরে পড়ে তার সেই স্বপ্ন গুড়েবালি হয়ে যায়। জীবনের অর্জিত সম্বলটুকু হারিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন তিনি।
মোহাম্মদ আলী আকবর জানান, নাসিম রিয়েল এস্টেট থেকে তাকে জানানো হয়েছিল প্রতিমাসে মাত্র ২ হাজার ২০০ টাকা কিস্তি দিতে হবে। এভাবে ১৪ বছর কিস্তি দিলেই একটি প্লটের মালিক হবেন তিনি। স্বপ্ন পূরণের সুযোগ ভেবে প্রতিমাসে তিনি নিয়মিত কিস্তির টাকা দিতে থাকেন। এরপর র্যাবের অভিযানে গ্রেফতার নাসিম রিয়েল এস্টেটের মালিক ইমাম হোসেন নাসিমের গ্রেপ্তারের পর জানতে পারেন তিনি প্রতারিত হয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘কথা ছিল রূপনগর আবাসিক এলাকায় মসজিদের সঙ্গেই থাকবে তার প্লটটি। বাড়ি তৈরি হলে আবাসিক এলাকার মসজিদের ইমামতির দায়িত্বও দেয়ার কথা ছিল তার। এ কারণে তাদের কথা বিশ্বাস হতো। বাস্তবে নিজের প্লটটি না দেখলেও ছবিতে দেখেছেন প্লট। সরল বিশ্বাসে তা বিশ্বাস করে প্রতিমাসে টাকাও দিয়েছি। ১৪ বছরে টাকা দিয়েছেন ৭ লাখ ৪০ হাজার ৬’শ । টাকা এমনকি মাটি ভরাটের জন্য তাকে দিতে হয়েছে ৪ লাখ ১২ হাজার ৬’শ টাকা।’
এ বিষয়ে র্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ‘এখন পর্যন্ত অনেকগুলো অভিযোগ আমরা পেয়েছি। মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য আমরা অভিযোগগুলো একত্রিত করে সিআইডিতে পাঠিয়েছি। পাশাপাশি অনুমতি নিয়ে আমরা চেকের কিছু ফটোকপিও পাঠিয়েছি। মামলা র্যাবের অধীনে তদন্তের জন্য আবেদিন করেছি।’
এদিকে নাসিম রিয়েল এস্টেটের প্লট বুকিং দিয়ে প্রতারণার শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন রাজীব চৌধুরী নামে এক ব্যাংক কর্মকর্তাও। তিনি তার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে টাকা দিয়েছিলেন।
রাজীব চৌধুরী বলেন, ‘আমাদেরই এক ভাই হেলাল উদ্দিন চৌধুরী। তিনি নিউ মডেল হাই স্কুলের সাবেক সহকারী প্রধান শিক্ষক। ওই স্কুলের শিক্ষকরা এবং তাদের আত্মীয়-স্বজন মিলে ১৫০ থেকে ২০০টি প্লট বুকিং দেয়। আমরা এককালীন ২০ হাজার টাকা করে জমা দিয়েছিলাম। তিন কাঠার একটি প্লট দেখিয়ে ৩ লাখ টাকার কিস্তি ধরিয়ে দেয়। আমি ৩ লাখ টাকার কিস্তির মধ্যে ২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা পরিশোধ করেছি। ৫০ হাজার টাকা জমি ভরাট করার জন্য দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু তারা তো পরে আর কিছুই করেনি। প্রতিবার জিজ্ঞাসা করতাম মাটি ফেলবেন কবে? আমাদের জায়গা দেয়ার কথা ছিল আশুলিয়ার তামান্না পার্কের দক্ষিণ পাশে নাসিম রিয়েল এস্টেটের প্রতিষ্ঠান ‘নাসিম সিটি’ নামের একটি হাউজিং প্রকল্পে।’
রাজীব বলেন, ‘আমরা সবাই মিলে র্যাব-৪ এ কাগজপত্র জমা দিয়েছি। নিউ মডেল হাই স্কুলের শিক্ষক, বিভিন্ন শিক্ষার্থীর অভিভাবক ও শিক্ষকদের আত্মীয়-স্বজনরাও নাসিমের দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন।’
র্যাব-৪ এর আইন কর্মকর্তা আখতারুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের কাছে সাড়ে ৩০০ অভিযোগ আছে। আরও ১০০ শর বেশি অভিযোগ আছে থানায়। পরে থানায় আরও কতটি মামলা হয়েছে এখনো আপডেট বলতে পারছি না। তবে ২০ থেকে ২৫টি মামলা হয়েছে। ২০ থেকে ৪০ জন মিলে একেকটি মামলা করেছেন। সাত জনকে বিদেশে পাঠানোর কথা বলেও টাকা নিয়েছেন প্রতারক নাসিম।’
তিনি বলেন, ‘নাসিমের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আসছে। মানিলন্ডারিংয়ে মামলাও হয়েছে। দুদকও মামলা করবে। মানিলন্ডারিং মামলার তদন্তের জন্য সিআইডির বিশেষ ইন্টালিজেন্স শিগগিরই কাজ শুরু করবে। মানিলন্ডারিংয়ে প্রমাণ পাওয়ার কারণে আমরা তথ্যসহ সকল কাগজপত্র ও অভিযুক্তদের তালিকা করে সিআইডিতে পাঠিয়েছি। আমার মনে হচ্ছে প্রতারণার অংক ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। তার প্রতারণার তালিকায় রয়েছে প্রবাসী, সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাও।’
র্যাবের এই কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘নাসিমের বিরুদ্ধে র্যাব-৪ বাদী হয়ে এখন পর্যন্ত ৪টি মামলা করেছে। এর মধ্যে অস্ত্র আইনে দুটি, মাদক আইনে একটি ও জাল টাকা উদ্ধারের ঘটনায় একটি মামলা করা হয়েছে। এছাড়া আরও নতুন ৪ থেকে ৫টি মামলা আছে। ৫৫টি মামলায় তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট আছে। কোর্টের মাধ্যমে সিআর মামলাও আছে। আমরাও তার বিষয়ে জানতে চেয়ে রিহ্যাবে চিঠি দিয়েছি।’
প্রসঙ্গত, গত ২ অক্টোবর রাজধানীর রূপনগর এলাকায় একটি গোপন আস্তানায় র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন নাসিম রিয়েল এস্টেটের মালিক ইমাম হোসেন নাসিম। তার নামে ৫৫টি মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। নাসিমের আস্তানা থেকে অস্ত্র, মাদকসহ নানা জিনিসও জব্দ করে পুলিশের এই এলিট ফোর্সটি। এর মধ্যে ছিল একটি ৭ পয়েন্ট ৬৫ মি.মি. বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগজিন, তিন রাউন্ড গুলি, এক লাখ ৩৫ হাজার টাকার জাল নোট, এক হাজার ৪০০ পিস ইয়াবা, দুই বোতল বিদেশি মদ, চারটি ওয়াকিটকি সেট, ছয়টি পাসপোর্ট, ৩৭টি ব্যাংক চেকবই এবং ৩২টি সিমকার্ড। এ সময় হালিমা আক্তার সালমা নামে তার স্ত্রীকেও গ্রেপ্তার করা হয়।
পরে নাসিমের বিরুদ্ধে র্যাব বাদী হয়ে অস্ত্র আইনে দুটি, মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি ও জাল টাকা উদ্ধারের ঘটনায় একটি মামলা করে।