স্বজনের অপেক্ষায় কুড়িয়ে পাওয়া মানিক

প্রশান্তি ডেক্স॥ ঢাকা মেডিকেল কলেজের স্পেশাল কেয়ার বেবি ইউনিটে রয়েছে শিশুটি। সে ভালো আছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। সামান্য জন্ডিস থাকায় চিকিৎসার অংশ হিসেবে তার চোখ ঢেকে দেওয়া হয়েছে। গত মধ্য ডিসেম্বরে শীতের রাত। ফায়ার সার্ভিস অফিসের কাছে উড়ালসেতুর থামের নিচে এক নারী। পরনে ঢলঢলে কামিজ আর পেটিকোট। না শুয়ে এমনকি না বসে শান্তি পাচ্ছেন না; তিনি ছটফট করছেন। কাছেই এক চা দোকানি অনেকক্ষণ ধরে দেখছেন তাঁকে। কিছুক্ষণ বাদে তিনিই ডেকে আনেন আংগুরী নামের এক নারীকে। ফিরে এসে দুজনে দেখেন, ফুটফুটে এক নবজাতকের জন্ম হয়েছে।
অভিভাবকের অভাবে এই নবজাতকের জায়গা হয়েছে এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের স্পেশাল কেয়ার বেবি ইউনিটে। ছোট্ট খাটে তার পরিচয় লেখা ‘বেবি অব আননোন’ (অপরিচিতের সন্তান)। কবজিতে লাগানো ব্যান্ডেও একই কথা লেখা। স্বজনের খোঁজে এখনও দিন কাটছে তার।
গত মঙ্গলবার রাতে কথা হচ্ছিল আংগুরী বেগমের সঙ্গে। তিনি আমাদের প্রতিনিধিকে বলেন, ১৮ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ১০টার দিকে চা দোকানি তাঁর বাসায় আসেন। তিনি বলেন, এক মা প্রসবযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। মাথাভর্তি জটা তাঁর। কাউকে কাছেও ঘেঁষতে দিচ্ছেন না। একজন ধাই দরকার। আংগুরী ধাই নিয়ে উড়ালসেতুর কাছে গিয়ে দেখেন, একটি ছেলেশিশু জন্মেছে। তার গলায় নাড়ি পেঁচিয়ে আছে। কিন্তু মায়ের শরীরের ভেতর গর্ভফুল রয়ে গেছে। তিনি আগুনে পুড়িয়ে নাড়িটি কাটেন। ততক্ষণে নবজাতকের শরীর ময়লায় মাখামাখি। ঠান্ডায় শরীর নীল হয়ে এসেছে। প্রসূতিকে হাসপাতালে নেওয়ার দায়িত্ব নেন ধাই, আর আংগুরীকে বলেন নবজাতককে নিয়ে বাসায় যেতে। আংগুরী নবজাতককে নিয়ে তাঁর সিদ্দিক বাজারের বাসায় আসেন।
মজার বিষয় হলো এই আংগুরী বেগমেরও একটা গল্প আছে। নবজাতকটি হাসপাতালে পৌঁছানোর আগে তা-ই শোনা যাক। আংগুরী বেগমের স্বামী ঘোড়ার গাড়ি চালান। তাঁরা থাকেন সিদ্দিক বাজারে। অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল তার। প্রথমে একটা মেয়ে হয়েছিল কিন্তু দু:খের বিষয় সেই মেয়েটি বাঁচেনি। পরে একটি ছেলে হয় আংগুরীর। আরেকটি সন্তানের শখ ছিল তার। ২০১৯ সালের শেষভাগে তিনি গর্ভধারণ করেন। চলতি বছরের জুলাইতে আরেকটা ছেলে হয় আংগুরীর। সেও বাঁচেনি। ২৪ দিন পর কোনো এক শুক্রবার সেই ছেলেটি মারা যায়। আংগুরী বলছিলেন, তাঁর স্বামী বিয়ের অনুষ্ঠান, শুটিংয়ে ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া দেন, নিজেও চালিয়ে নিয়ে যান। করোনায় কাজ ছিল না। খাবারের অভাবে ঘোড়া মরে গেছে। তিনি নিজেও একরকম অর্ধাহারে–-অনাহারে ছিলেন। কম ওজনের ছেলে জন্মেছিল বলে বাঁচেনি। পথে জন্মানো শিশুটিকে কোলে নিয়ে আংগুরীর মনে হয়, এক শুক্রবার তাঁর ছোট ছেলেটি মারা গেছে, আরেক শুক্রবার সেই আবার ফিরে এসেছে।
উড়ালসেতু থেকে নবজাতককে নিয়ে আংগুরী ঝটপট বাসায় ফেরেন। তাঁর মায়ের পুরোনো সুতির শাড়ি ছিঁড়ে প্রথমে কুড়িয়ে পাওয়া নবজাতককে পরিষ্কার করেন। তারপর মৃত ছেলের পোশাক পরিয়ে পেঁচিয়ে রাখেন তোয়ালে দিয়ে। কপালে একটা টিপ দিয়ে দুধ খাওয়ান।
এর মধ্যেই ফোন আসে শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. শামসুর রহমানের। নবজাতক ছাড়া মায়ের চিকিৎসা হবে না বলে জানান ওই পুলিশ সদস্য। পুলিশের সহযোগিতায় মা ও নবজাতককে নিয়ে আংগুরীরা রওনা দেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছাতে রাত দেড়টা বেজে গিয়েছিল। চিকিৎসকেরা এক এক করে নবজাতকদের ভর্তি করছিলেন। কেউ কেউ বেশ অসুস্থ। কিন্তু এই নবজাতককে কোলে নিয়েই তাঁদের জানান, সে সুস্থ আছে। ওর মা নিজের নামটিও বলতে পারেননি। কোথা থেকে কবে এসেছেন, কিছুই বলতে পারেননি। তিনি কোন ফাঁকে কখন বেরিয়ে গেছেন, তাও জানেন না।
আংগুরী বেগমর অবশ্য আবারও গিয়েছিলেন ওই নবজাতকের মায়ের কাছে। সেতুর নিচেই শুয়েবসে থাকতে দেখেছেন। কাছে গেলে কামড়াতে আসেন। সন্তানের জন্য মনঃকষ্ট থেকে কি না বোঝেন না। কোনো কিছুই বলেন না।

Leave a Reply

Your email address will not be published.