ধান উৎপাদন ও কৃষকের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে কাজ করুন;কৃষিমন্ত্রী

প্রশান্তি ডেক্স ॥ দেশের বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ধান উৎপাদন আরো বাড়ানোর পাশাপাশি কৃষকের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য ব্রির বিজ্ঞানীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক, এমপি। একই সঙ্গে তিনি ধানি জমিতে ফসলের নিবিরতা বাড়ানো, ফসলের উন্নত প্রক্রিয়াজাতকরণ, উন্নত পুষ্টিগুণ সম্পন্ন নিরাপদ রফতানি সম্ভাবনাময় ধানের জাত উদ্ভাবনের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেন।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে গাজীপুরে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিটের (ব্রি) বার্ষিক গবেষণা পর্যালোচনা কর্মশালা ২০১৯-২০ এর উদ্বোধনী সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় এসব কথা বলেন তিনি। কর্মশালায় মন্ত্রী আরো বলেন, প্রতি বর্গকিলোমিটারে সর্বাধিক ঘনবসতির দেশ হওয়া সত্ত্বেও ব্রির বিজ্ঞানীদের কল্যাণে দেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বনির্ভর অবস্থানে রয়েছে। এখন নতুন চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে, আর সেটি হলো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষির যথাযথ যান্ত্রিকায়ন ও বাণিজ্যিকীকরণ এবং ধান উৎপাদন তথা সার্বিক কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাকে কৃষকের জন্য লাভজনক করা। এজন্য তিনি বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। ব্রির মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল এমপি, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মেসবাহুল ইসলাম, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান মো. সায়েদুল ইসলাম, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান কৃষিবিদ ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার, ব্রির পরিচালক (প্রশাসন ও সাধারণ পরিচর্যা) ড. মো. আবুবকর ছিদ্দিক সহ অন্যরা বক্তব্য রাখেন। কর্মশালায় ‘গবেষণা অগ্রগতি ও অর্জন ২০১৯-২০’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ব্রির পরিচালক (গবেষণা) ড. কৃষ্ণপদ হালদার।
ব্রি, বারি, বিএআরসি, ডিএই, ইরিসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরা অনুষ্ঠানে যোগ দেন। পরবর্তী ছয়দিন ধরে চলবে কর্মশালার বিভিন্ন কারিগরি অধিবেশন। কর্মশালার কারিগরি অধিবেশনগুলোতে গত এক বছরে ব্রির ১৯টি গবেষণা বিভাগ ও নয়টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের গবেষণা ফলাফল সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সামনে তুলে ধরা হবে।
ব্রি সূত্রে জানা গেছে, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিগত এক বছরে ধান গবেষণা ও সম্প্রসারণ কাজের অর্জন ও অগ্রগতির বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করা হয়। কর্মশালার কারিগরি অধিবেশনগুলোতে গত এক বছরে ব্রির ১৯টি গবেষণা বিভাগ ও নয়টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের গবেষণা ফলাফল সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সামনে তুলে ধরা হবে। গত দুই বছরে মোট ১১টি উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে এবং এর মাধ্যমে ব্রি উদ্ভাবিত মোট ধান জাতের সংখ্যা হলো ১০৫টি। এর মধ্যে সাতটি হাইব্রিড ধানের জাত রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্রি উদ্ভাবিত নতুন ধানের জাতগুলো হলো ব্রি ধান৯০, ব্রি ধান৯১, ব্রি ধান৯২, ব্রি ধান৯৩, ব্রি ধান৯৪, ব্রি ধান৯৫, ব্রি ধান৯৬, ব্রি ধান৯৭, ব্রি ধান৯৮ ও ব্রি ধান৯৯। রোপা আমন, রোপা আউশ ও বোরো মৌসুমের জন্য উদ্ভাবিত এসব গড় ফলন প্রতি হেক্টরে পাঁচ থেকে সাড়ে আট টন। সাম্প্রতিক সময়ে ব্রি উদ্ভাবিত জাতের মধ্যে আরো আছে জলমগ্নতা ও জলাবদ্ধতা সহনশীল আমন ধানের জাত ব্রি ধান৭৯, জেসমিন সদৃশ সুগন্ধি আমন ধানের জাত ব্রি ধান৮০, অনুকূল পরিবেশের উপযোগী স্থানীয় জনপ্রিয় জিরাশাইল জাতের অনুরূপ বোরো ধানের জাত ব্রি ধান৮১, নেরিকা ১০ এর বিশুদ্ধ সারি থেকে উদ্ভাবিত রোপা আউশ ধানের স্বল্প মেয়াদি জাত ব্রি ধান৮২, স্থানীয় জনপ্রিয় কটকতারা জাতের অনুরূপ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন বোনা আউশ জাত ব্রি ধান৮৩, যা চারা অবস্থায় মধ্যম মাত্রায় খরা সহনশীল। এছাড়া আছে উচ্চমাত্রার জিংক (২৭.৬ পিপিএম) সমৃদ্ধ বোরো ধানের জাত ব্রি ধান৮৪, বৃহত্তর কুমিল্লা অঞ্চলের উপযোগী রোপা আউশ ধানের জাত ব্রি ধান৮৫,অ্যানথার কালচার পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত বোরো ধানের জাত ব্রি ধান৮৬। অধিকন্তু গত বছর ব্রি উদ্ভাবিত জাতের মধ্যে আরো আছে দু’টি হাইব্রিড ধানের জাত-ব্রি হাইব্রিড ধান৫ ও ব্রি হাইব্রিড ধান৬।
ব্রি পূর্ববর্তী গত ১০ বছরে ৫৪টি উফশী ধানের জাতসহ বেশ কিছু প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও উন্নয়ন করেছে। উদ্ভাবিত এ জাতগুলোর মধ্যে রয়েছে লবণাক্ততা সহনশীল বোরো জাত ব্রি ধান৬১ ও ব্রি ধান৬৭, জিঙ্ক সমৃদ্ধ ব্রি ধান৬২, ব্রি ধান৬৪, ব্রি ধান৭২ ও ব্রি ধান৭৪, ঐতিহ্যবাহী বালাম চালের অনুরূপ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন এবং সরু বালাম নামে পরিচিত জাত ব্রি ধান৬৩, সরাসরি বপনযোগ্য আগাম আউশ ধানের জাত ব্রি ধান৬৫, খরা সহনশীল ও উচ্চ মাত্রার প্রোটিন সমৃদ্ধ বোরো জাত ব্রি ধান৬৬, বোরো মৌসুমের আদর্শ উফশী জাত ব্রি ধান৬৮ এবং কম খরচে আবাদযোগ্য উফশী জাত ব্রি ধান৬৯।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্রি উদ্ভাবিত জাতের মধ্যে আরো আছে, দেশে কৃষক মহলে ব্যাপক জনপ্রিয় এবং বোরো মৌসুমে সর্বোচ্চ ফলন দিতে সক্ষম ব্রি ধান২৯ এর সমপর্যায়ের গুণাগুণ সম্পন্ন ব্রি ধান৫৮ এবং আমন মৌসুমের জনপ্রিয় বিআর১১ এর সমতুল্য ব্রি ধান৪৯। তবে এটি ব্রি ধান২৯ এর চেয়ে প্রায় এক সপ্তাহ আগাম। পাশাপাশি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রেক্ষাপটে নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলার লক্ষ্যে ব্রি বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত নয়টি লবণ-সহিষ্ণু, দু’টি জলমগ্নতা সহিষ্ণু, তিনটি খরা সহিষ্ণু, একটি খরা পরিহারকারী, দু’টি শীত সহনশীল এবং চারটি জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। বিভিন্ন ধরনের বৈরি পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার উপযোগী আরো ধানের জাত উদ্ভাবনের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। ধানের গুণাগুণ বৃদ্ধির জন্য ভিটামিন এ এবং আয়রণ সমৃদ্ধ ধান উদ্ভাবনের কাজও চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ব্রি উদ্ভাবিত সরু ও সুগন্ধযুক্ত বোরো মৌসুমের জাত ব্রি ধান৫০ বা বাংলামতি রফতানি সম্ভাবনাময়। বর্তমানে দেশের ৮০ ভাগ জমিতে ব্রি উদ্ভাবিত ধানের জাতের চাষাবাদ হয় এবং এর থেকে আসে দেশের মোট ধান উৎপাদনের শতকরা ৯১ ভাগ। ব্রি এ পর্যন্ত সাতটি হাইব্রিডসহ মোট ১০৫টি উফশী ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে যার মধ্যে বেশ ক’টি প্রতিকূল পরিবেশ সহনশীল এবং উন্নত পুষ্টিগুণ সম্পন্ন। আশা করা যাচ্ছে, এগুলো কৃষক পর্যায়ে জনপ্রিয় হবে এবং সামগ্রিকভাবে ধান উৎপাদন বাড়বে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.