প্রশান্তি ডেক্স ॥ কয়েক মাস ধরে বাড়ছে ভোজ্যতেলের দাম। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ‘সরবরাহ ঘাটতি, রপ্তানিতে কর বৃদ্ধিসহ মজুত বাড়াতে চীনের বিপুল পরিমাণে ক্রয় করার’ কারণে পণ্যটির দাম বাড়ছে। আর এর প্রভাব পড়েছে বাজারে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশের খুচরা বাজারে চার মাসের ব্যবধানে প্রতি লিটার সয়াবিন ক্রয়ে ভোক্তাকে ৪০-৫০ টাকা বাড়তি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটি নিয়ে বেকায়দায় পড়ছেন সাধারণ ক্রেতা। খরচ বাঁচাতে ক্রেতারা সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বিক্রয় কেন্দ্রে ভিড় জমাচ্ছেন। তবে চাহিদামতো তেল না পেয়ে অনেকেই ক্ষুব্ধ।
এদিকে আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি অনুযায়ী দেশে তেলের দাম আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন দেশের ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা। তাই এই পণ্যটির দাম সহনীয় রাখতে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে আমদানিতে তিন স্তরের ভ্যাটের পরিবর্তে এক স্তরের ভ্যাট নির্ধারণের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আর এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) বলা হয়েছে। চলতি মাস শেষে ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের নিয়ে বৈঠক হবে। এদিকে রাজধানীর খুচরা বাজার ঘুরে ও মুদি বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোববার প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চার মাস আগে ছিল ৮০ টাকা। পাশাপাশি খুচরা বাজারে প্রতি লিটার পাম অয়েল সুপার বিক্রি হয় ১১৫-১২০ টাকায়। চার মাস আগে ছিল ৭০ টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিটি গ্রুপের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বিশ্বব্যাপী ভোজ্যতেলের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু সেভাবে উৎপাদন ও সরবরাহ নেই। তাই দাম হুহু করে বাড়ছে। যেখানে সয়াবিন প্রতি টন আগে ৭০০ ডলার ছিল, সেখানে এখন ১২২০ ডলারে কিনতে হচ্ছে। তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে চীনের বিপুল পরিমাণ সয়াবিন ক্রয়।
কেননা, ভবিষ্যতে সয়াবিনের সংকট দেখা দিতে পারে-এমন শঙ্কা থেকে তারা বেশি করে ক্রয় করে মজুদ করছেন। করোনার ধাক্কা তো আছেই। তা ছাড়া আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল ও আমেরিকায় তেলের সরবরাহ কমে গেছে। এ ছাড়া ভ্যাট বেশি হওয়ায় চাইলেও কম মূল্যে পণ্যটি সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। তিন পর্যায়ে ভ্যাট-ট্যাক্স মড়ার ওপর যেন খাঁড়ার ঘা। আমদানিতে ২০ শতাংশ, উৎপাদনে ১৫ শতাংশ এবং বিক্রয় পর্যায়ে ৫ শতাংশ করে মোট ৪০ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। সেটা এক স্তরে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে। সরকার যদি এখানে ব্যবস্থা নিতে পারে, তাহলে দামের লাগাম কিছুটা টেনে ধরা সম্ভব হবে।
রাজধানীর নয়াবাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা রেজাউল করিম কী করে খেয়ে বাঁচব জানি না। চালের দাম বাড়তি, সঙ্গে একাধিক পণ্য বাড়তি দরে কিনতে হচ্ছে। পাশাপাশি ভোজ্যতেল প্রতি মাসেই হুহু করে বাড়ছে। এখন এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে, যেন পণ্যটি কিনতে নাভিশ্বাস উঠছে। প্রতিনিয়ত বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে। রাজধানীর রামপুরা কাঁচাবাজারে ভোজ্যতেল কিনতে আসা দিনমজুর মো. হাবিবুল্লাহ বলেন, বেশি দামের কারণে বোতলজাত তেল কখনোই কেনা হয় না। খোলা সয়াবিনই কিনি। তবে এক লিটার এখন ১২৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে। আগে কিনতাম ৮০ টাকায়। রান্নায় তেল লাগবেই। আমাদের মতো মানুষের বাড়তি টাকা ব্যয়ে দিশাহারা হয়ে পড়তে হয়। সরকারকে এদিকে নজর দিতে হবে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, ভোজ্যতেলের দাম কমাতে এখনই সরকারের উদ্যোগ নিতে হবে। এই পণ্যটি অতি ব্যবহৃত। আর বিশ্ববাজারেই দাম বাড়তি। তাই দেশের বাজারে ভ্যাট-ট্যাক্স কমিয়ে কতটা কীভাবে সমন্বয় করা যায়, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। এতে ভোক্তা একটু হলেও স্বস্তি পাবে। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ভোজ্যতেলের বিষয়টি আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে। সে জন্য দাম বাড়ার প্রভাব আমাদের দেশেও পড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজার ও দেশের বাজারে কী পরিমাণ এ পণ্যটি বাড়ছে-এটা নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্টরা বৈঠক করছে। ভোক্তার স্বার্থে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অন্যদিকে রাজধানীর মৌলভীবাজারে পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেখানে প্রতি মন (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৪৪০০ টাকায়। গত সপ্তাহে ছিল ৪২০০ টাকা। পাইকারি দরে পাম অয়েল সুপার প্রতি মন বিক্রি হচ্ছে ৩৯০০ টাকা। গত সপ্তাহে ছিল ৩৮০০ টাকা।
গত রোববার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ার কারণে দেশের বাজারেও দাম বেড়েছে। এ ছাড়া সরবরাহ ব্যবস্থায়ও একটু সমস্যা রয়েছে। সব মিলিয়ে চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের নিয়ে বৈঠক হওয়ার কথা আছে। তা ছাড়া ভ্যাটের বিষয়ে এনবিআরকে ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে।