প্রশান্তি ডেক্স ॥ বেসিক ব্যাংকে ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার ঋণই রয়েছে ৬০ প্রতিষ্ঠানের কাছে, যা মোট জালিয়াতির ৭১ শতাংশ। এর মধ্যে বিধি ভঙ্গ করে ২৬ গ্রাহককে দেওয়া হয়েছে বড় অঙ্কের ঋণ। এর মধ্যে ১৮ গ্রাহকের ঋণেই করা হয়েছে জালিয়াতি। এদের কাছে ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা, যা মোট জালিয়াতির ৫৯ শতাংশ।
বেসিক ব্যাংকের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে গত বছরের শেষদিকে এ প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এতে বলা হয়, ব্যাংকের গুলশান, শান্তিনগর, দিলকুশা ও ঢাকার প্রধান শাখায় হয়েছে বড় ধরনের জালিয়াতি। পাশাপাশি ব্যাংকের পুরান ঢাকার বাবুবাজার ও চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শাখায়ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এ ব্যাপারে এখন আরও তদন্ত হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আলম বলেন, করোনার কারণে গত বছর শীর্ষ খেলাপিদের কাছ থেকে খুব বেশি ঋণ আদায় করা সম্ভব হয়নি। নতুন বছর থেকে ঋণ আদায়ে বড় ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে খেলাপিদের বন্ধকি সম্পদ নিলাম করা হবে। যারা ঋণ নিয়ে আড়ালে ছিল, তাদেরকে শনাক্ত করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, বেসিক ব্যাংকের পুরো নাম হচ্ছে বাংলাদেশ স্মল ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক লিমিটেড। বেসরকারি খাতে পর্যাপ্ত ক্ষুদ্রশিল্প গড়ে তুলতে সরকারি খাত থেকে অর্থায়ন বাড়ানোর লক্ষ্যেই ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশনেও রয়েছে ক্ষুদ্রশিল্পে ঋণ দেওয়ার কথা। কিন্তু ব্যাংক ক্ষুদ্রশিল্পে ঋণ দেওয়ার চেয়ে বড় শিল্পে ঋণ দিতে বেশি আগ্রহী। ফলে বড় অঙ্কের ঋণেই হয়েছে বড় জালিয়াতি।
এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধি অনুযায়ী, কোনো ব্যাংকের মোট মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি কোনো একক গ্রুপ বা ব্যক্তিকে ঋণ দিলে তা বড় অঙ্কের ঋণ হিসাবে চিহ্নিত হবে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বেসিক ব্যাংক থেকে ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এই তিন বছরে ঋণ জালিয়াতি করে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৬ প্রতিষ্ঠানকে বিধি ভঙ্গ করে বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়া হয়েছে ৪ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা। এদের ১৮টি প্রতিষ্ঠানের ঋণে বড় ধরনের জালিয়াতি করা হয়েছে। এর পরিমাণ ২ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা। এসব ঋণ এখন মন্দ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে এমিরান্ড অটো ব্রিকস ২৩৭ কোটি, নীল সাগর অ্যাগ্রো ১৮৭ কোটি, ফিয়াজ গ্রুপ ১৯৬ কোটি, বর্ষণ বীথি গ্রুপ ১৬৯ কোটি, ম্যামকো কার্বন ১৬৬ কোটি, ভাসাভি ফ্যাশন ১৫৮ কোটি, ওয়েল ট্যাক্স অ্যান্ড এলাইড ১৯২ কোটি, আজবিহা ইয়থ ১২৬ কোটি, আর আই এন্টারপ্রাইজ ১৩২ কোটি, রাইজিং গ্রুপ ১৩২ কোটি, ডেল্টা সিস্টেমস লিমিটেড ১২৯ কোটি, ম্যাপ অ্যান্ড মুলার গ্রুপ ১২৩ কোটি, এমিরাল্ড ওয়েল অ্যান্ড অ্যালাইড ১২৪ কোটি, রিজেন্ট ওয়েভিং ১১৯ কোটি, আইজি নেভিগেশন লিমিটেড ১২০ কোটি, বে নেভিগেশন লিমিটেড ১১৭ কোটি, প্রোফিউশন টেক্সটাইল লিমিটেড ১১২ কোটি এবং মা টেক্সের কাছে ১১১ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। এসব ঋণ আদায়ে ব্যাংক এখন জোরালো তৎপরতা শুরু করেছে। ২৬ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নিয়মিত ঋণ থেকে খেলাপি হওয়ার আগের ধাপে অর্থাৎ বিশেষ হিসাবে (এসএমএ) অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ৪টি প্রতিষ্ঠানের ৯০৫ কোটি টাকার ঋণ। নিয়মিত রয়েছে আরও ৪টি প্রতিষ্ঠানের ৭০৩ কোটি টাকার ঋণ। ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশের কম অর্থাৎ ছোট ও মাঝারি অঙ্কের ৪২টি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে জালিয়াতি করা হয়েছে। এগুলোয় টাকার পরিমাণ ৫৫৫ কোটি টাকা। এসব জালিয়াতির বেশির ভাগ অংশই ছোট ছোট ঋণ। বিশেষ করে শিপিং খাতে দেওয়া হয়েছে। যেগুলো নিয়ে এখন আরও তদন্ত হচ্ছে।
ব্যাংক থেকে জালিয়াতি করে ঋণ নিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন এমন ৫/৬ জন ব্যক্তির সন্ধান পেয়েছে ব্যাংক। এসব ঋণের বিপরীতে যথেষ্ট সম্পদ বন্ধক হিসাবে ব্যাংকের কাছে নেই। এদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এদের সবার কাছেই বড় অঙ্কের ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে ওয়াহিদুর রহমান নামের এক ব্যবসায়ীর কাছে ব্যাংকের পাওনার পরিমাণ ৭৭০ কোটি টাকা। ব্যাংকের দিলকুশা, শান্তিনগর এবং গুলশান-এই তিন শাখা থেকেই ওয়াহিদুর রহমান নামে-বেনামে ঋণ নিয়েছেন। তিনি অটো ডিফাইন নামে শান্তিনগর শাখা থেকে ২৫০ কোটি টাকা ঋণ নেন। ওই ঋণ তিনি পরে সিআর এন্টারপ্রাইজের নামে হস্তান্তর করেন। দুটি প্রতিষ্ঠানেরই মালিক ওয়াহিদুর রহমান। পরে এবি রাশেদ নামে ওয়াহিদুর রহমানের এক কর্মচারীকে মালিক বানিয়ে এবি ট্রেড লিংক নামে একটি প্রতিষ্ঠানে ঋণ নেওয়া হয় ৬৭ কোটি টাকা। এছাড়া মা টেক্সের নামে গুলশান শাখা থেকে ৮০ কোটি, নিউ অটো ডিফাইনের নামে ৯০ কোটি টাকা, ফিয়াজ এন্টারপ্রাইজের নামে ১৫২ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়, যা এখন মন্দ হিসাবে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।