প্রশান্তি ডেক্স ॥ গাইবান্ধার পলাশবাড়ীর জুনদহ এলাকায় গত মে মাসে রডবাহী ট্রাক দুর্ঘটনায় মারা যান ১৩ জন শ্রমিক। আইন অনুযায়ী মালবাহী ট্রাকে যাত্রী বহন নিষিদ্ধ। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে নিহত এই ১৩ জনকে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে বহন করছিলেন চালক। গত সাত মাস পার হলেও এখনো এ মামলায় চার্জশিট দিতে পারেনি পুলিশ। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পলাশবাড়ী থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মতিউর রহমান তদন্তকাজ চলছে। কবে নাগাদ চার্জশিট দেওয়া হবে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তদন্ত শেষ হতে আরও ২-৩ মাস সময় লাগতে পারে বলে তিনি জানান। শুধু এই দুর্ঘটনার মামলাই নয়, ২০২০ সালে সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনার ২ হাজার ৭৮৯টি মামলা তদন্তাধীন।এ সময়ে চার্জশিট দাখিল হয়ে বিচারধীন রয়েছে মাত্র ২৬টি মামলা। পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, ওই বছর সারা দেশে ৪ হাজার ১৯৮টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে।
এতে সড়কে মারা গেছেন ৩ হাজার ৯১৮ জন এবং আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৮২৬ জন। এসব ঘটনায় ২ হাজার ৯৫৬টি মামলা হয়েছে। আর সাধারণ ডায়েরি হয়েছে ১ হাজার ২৪৬টি। মামলা হয়েছে এমন ২ হাজার ৯৫৬টি দুর্ঘটনার মধ্যে তদন্ত হচ্ছে ২ হাজার ৭৮৯টির। যদিও বেসরকারি সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনা এবং হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি। সংশ্লিষ্টরা জানান, সড়কে দুর্ঘটনার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী চালকরা। বর্তমানে যানবাহনের তুলনায় সাত লাখের বেশি চালকের অভাব রয়েছে। এছাড়া সরকার আইন শিথিল করায় হালকা (প্রাইভেট কার) যান চালানোর লাইসেন্স দিয়ে মধ্যম মানের এবং মধ্যম মানের যানবাহনের লাইসেন্স দিয়ে ভারী যান চলানোর সুযোগ দিয়েছে।
গত সোমবার রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে আকাশ ইকবাল (২৬) ও হাজারিকা মায়া মিতু (২২) দম্পতিকে চাপা দেওয়া আজমেরি গ্লোরি পরিবহনের বাসচালক তসিকুল ইসলাম। ওই চালক প্রাইভেট কার চালানোর লাইসেন্স নিয়ে বাস চালাচ্ছিলেন। ওই ঘটনায় মামলা হয়েছে। সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, নানা কারণে দুর্ঘটনার মামলার তদন্ত কার্যক্রম দীর্ঘদিন ঝুলে থাকে। অনেক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে পরিবহণ মালিক ও শ্রমিকনেতাদের সখ্য রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সাক্ষী পাওয়া যায় না। তবে যে কারণেই হোক না কেন, দীর্ঘসূত্রতার কারণে মামলা ও বিচারের ওপর আগ্রহ হারিয়ে ফেলে দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তি বা তার পরিবার। এতে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালক ও তার সহযোগীরা পার পেয়ে যান। তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন। এ বিষয়ে বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেন, বিচার ও তদন্তের দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেকের ধারণা মামলা করে কিছু হবে না। তাই দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গেলে তার স্বজনরা স্থানীয় প্রশাসনের কাছে আবেদন করে লাশ নিয়ে যান।
এছাড়া দুর্ঘটনায় যারা মারা যান, তাদের বসতবাড়ি বা সাক্ষীদের অবস্থান অন্য এলাকায় হয়ে থাকে। এটিও মামলা কম হওয়ার অন্যতম কারণ। এসব কারণে সুযোগ পেয়ে যান দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালক ও অন্যরা। তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার তদন্তে পুলিশের অভিজ্ঞতার ঘাটতি আছে। তারা প্রকৃত কারণ না খুঁজে গৎবাধাভাবে চালককে দায়ী করে চার্জশিট দেন। এতেও মামলা দুর্বল হয়ে যায়। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের প্রধান মনিবুর রহমান বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার মামলা তদন্তে বিলম্বের মূল কারণ হলো সাক্ষ্যপ্রমাণ না পাওয়া। কারণ, পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ না থাকায় আদালতে চার্জশিট দেওয়া যায় না। যথাযথ সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়া চার্জশিট দেওয়া হলে আসামিদের খালাস পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ডিএমপির এ অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার পর অনেক সময় মামলার বাদী পেতেই কষ্ট হয়। কোনো কোনো সময় মামলা হতে বিলম্ব হয়। তখন সাক্ষী খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ, দুর্ঘটনা হয় রাস্তায়। যারা সাক্ষী থাকেন, তারা বেশির ভাগই পথচারী। তদন্তকালে তাদের খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক সময় কয়েকবার নোটিশ করেও তাদের পাওয়া যায় না।