ঐতিহ্য, আবেগের লর্ডস এবার করোনাকে বিদায় করতেও

প্রশান্তি স্পোর্স্ট ডেক্স ॥ ক্রিকেটের কত স্মৃতিই–না এই মাঠে। কতই–না কিংবদন্তি! অর্জস ইতিহাসে ঠাসা এই মাঠের প্রতিটি ইঞ্চি, কণা। এই মাঠের ঘাসও সাক্ষী হয়ে আছে ২০০ বছরের গল্পগাথার। ক্রিকেটের তীর্থ, আবাস—অনেক কিছুই বলা হয় এটিকে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ড একটা আবেগের নাম। ব্রিটেন সেই আবেগের জায়গা থেকেই এই লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডকে এবার ব্যবহার করছে করোনা অতিমারিকে বিদায় করার অন্যতম মঞ্চ হিসেবে।
গত রোববার থেকে লর্ডসকে ব্যবহার করা হচ্ছে করোনার টিকাকেন্দ্র হিসেবে। হাসপাতাল, ক্যাথেড্রাল, মসজিদকেও টিকাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডকেও এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হলো। অতীতেও ব্রিটেনের জাতীয় গুরুত্ববহ পরিস্থিতিতে এই ঐতিহাসিক মাঠকে ব্যবহার করা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই মাঠ ব্যবহৃত হয়েছে ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর নিয়োগকেন্দ্র হিসেবে। এখানে এসেই তরুণেরা বিমানবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য শারীরিক পরীক্ষা দিতেন।
ক্রিকেটের স্মৃতি জড়িয়ে থাকা লর্ডসের অনেক কিছুকেই করোনা টিকাকেন্দ্রের অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ক্রিকেটের স্কোরবোর্ডে উঠছে টিকার বিভিন্ন তথ্য। সভাকক্ষটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে টিকাদানের কাজে নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীদের অস্থায়ী আবাসন হিসেবে।
চার দিন ধরে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষকে এখানে টিকা দেওয়া হয়েছে। এখন এই সংখ্যা আরও বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন লর্ডসের টিকাকেন্দ্রের অন্যতম কর্মকর্তা ঋষি চোপড়া, ‘আমরা প্রতিদিন দুই হাজার মানুষকে এখানে টিকা দিতে চাই। মানুষও এমন ঐতিহাসিক একটা জায়গায় এসে টিকা নিতে পেরে দারুণ আনন্দিত। লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডের কর্মকর্তারাও আমাদের দারুণ সহায়তা করছেন।’
লর্ডসে টিকা দিতে এসে দারুণ খুশি ৭১ বছর বয়সী গেরারডাউন হেনেগান। কেবল খুশিই নন, তিনি গর্বিতও, ‘এমন দারুণ ঐতিহাসিক একটা স্থানে টিকা নিচ্ছি। গর্ব হচ্ছে। কত ধ্রুপদি সব ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে এই মাঠে, কত কিংবদন্তি ক্রিকেটার খেলেছেন এখানে। এই মাঠে কত ঘটনা, কত স্মৃতি।’
লর্ডস ক্রিকেট মাঠের মালিক মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাবও (এমসিসি) দারুণ গর্বিত জাতীয় স্বার্থে আবারও এই মাঠ কাজে আসছে বলে। এমসিসির কর্মকর্তা জন উইলিয়ামস মনে করেন, লর্ডসও করোনা মহামারিকে বিদায় করতে বড় অবদান রাখছে, ‘আমার মনে হয়, করোনা মহামারিকে বিদায় করতে সবারই নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করতে হবে। লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডও এই কাজে আসছে, এটা বড় ব্যাপার।’ ব্রিটেনে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রায় এক লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। এক বছর ধরে এই বৈশ্বিক মহামারিতে বিপর্যস্ত দেশগুলোর একটি ব্রিটেন। করোনার কারণে গত মার্চে ক্রিকেট বিশ্বব্যাপীই স্থগিত হয়ে যায়। জুলাইতে ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ দিয়ে ক্রিকেট আবারও ফেরে। এখন অবশ্য প্রতিটি দেশই ক্রিকেট মাঠে রেখেছে, তবে করোনা ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কায় দর্শকেরা বঞ্চিত হচ্ছেন মাঠে বসে প্রিয় তারকাদের খেলা দেখতে। লর্ডসেও সবশেষ মৌসুমে কোনো দর্শক মাঠে বসে খেলা দেখতে পারেননি। আশা করা যাচ্ছে, করোনা টিকা এসে পড়ায় ২০২১ মৌসুমে আবারও লর্ডসে ফিরতে পারবেন দর্শকেরা। আগামী মে মাসে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট দল ইংল্যান্ড সফর করবে। আগস্টে যাবে ভারত। এই দুটি দলই লর্ডসে খেলবে।
১৮১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত লন্ডন শহরের এই মাঠের নামকরণ করা হয়েছে প্রতিষ্ঠাতা টমাস লর্ডসের নামানুসারে। এই স্টেডিয়ামের চত্বরে রয়েছে তিনটি মাঠ। প্রতিষ্ঠাকালে মাঠটিকে ওল্ড গ্রাউন্ড বা ডরসেট স্কয়ার বলা হয়। তৃতীয় মাঠটি বর্তমানে লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডের মূল। মিডল গ্রাউন্ড নামে পরিচিত দ্বিতীয় মাঠটি বর্তমানে পরিত্যক্ত। লর্ডসে ১৯৭৫, ১৯৭৯, ১৯৮৩, ১৯৯৯ ও ২০১৯ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনাল হয়েছে। ২০০৯ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালও এখানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আগামী জুনে ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম ফাইনালও হওয়ার কথা এই মাঠে। ঐতিহ্যবাহী লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডের চোখে পড়ার মতো আইকনই হচ্ছে সাদা চকচকে মিডিয়া বক্সটি। গ্যালারির ওপর সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা এই মিডিয়া বক্স লর্ডসের আইকনিক প্রতিচ্ছবি। লন্ডনের সেন্ট জোন্স উড এলাকায় অবস্থিত স্টেডিয়ামটি ক্রিকেটের হোম অব ক্রিকেট নামে পরিচিত। ঐতিহ্যবাহী এই স্টেডিয়ামের ২০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশেষ একটি ম্যাচ আয়োজন করা হয় ২০১৪ সালে। ৫ জুলাই সেই ম্যাচে এমসিসি একাদশের অধিনায়ক ছিলেন শচীন টেন্ডুলকার। অন্যদিকে, বিশ্ব একাদশের নেতৃত্বে ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার কিংবদস্তি লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্ন। পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো ক্রিকেট স্টেডিয়ামের মধ্যে এটি অন্যতম। বয়সও হয়ে গেছে প্রায় ২০৫ বছর। ইতিহাস-ঐতিহ্যে সবদিক দিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে লর্ডস সমাদৃত। বহু স্মরণীয় ঘটনারও সাক্ষী হয়ে আছে এই ভেন্যু।

Leave a Reply

Your email address will not be published.