প্রশান্তি ডেক্স ॥ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন ঘিরে শঙ্কা আগেই ছিল। ভোটের আগে প্রচারের সময় দুজনের মৃত্যুও হয়েছিল। এ কারণে ভোটের দিনের পরিবেশ স্বাভাবিক রাখতে নেওয়া হয়েছিল বড় ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা। সিটি এলাকায় ভোটারদের নিরাপত্তা এবং সুষ্ঠু ভোটের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৯ হাজার সদস্য মোতায়েন করা হয়েছিল। কিন্তু তাতেও ভোট দিয়ে সহিংসতা ঠেকানো যায়নি। সকালে ভোট শুরুর পর বিভিন্ন কেন্দ্রে সহিংসতার খবর পাওয়া যাচ্ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন প্রার্থীদের সমর্থকদের অস্থিরতা বাড়ছিল। এর মধ্যেই সকাল ১০টায় খবর পাওয়া গেল নগরের পাহাড়তলীর একটি কেন্দ্রের বাইরে গুলিতে মারা যান আলাউদ্দিন নামে এক ব্যক্তি।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে নির্বাচন ঘিরে উত্তপ্ত অবস্থা আগের নির্বাচনগুলোতে ছিল। ভোটের দিন ‘ভোট উৎসবের’ মধ্যে মৃত্যুর ঘটনা আগে কবে ঘটেছিল, সে কথা মনে করতে পারেন না অনেকেই। বিশেষ করে ২০১০ ও ২০১৫ সালের দুটি নির্বাচনে কোনো ধরনের রক্তক্ষয়ের মতো ঘটনা ঘটেনি। ২০০৫ সালের নির্বাচনে ভোটের আগের দিন নিহত হয়েছিলেন শ্রমিক লীগের এক কর্মী। এর আগে ১৯৯৪ সালে প্রথম চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচন ঘিরে কারও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ২৭ বছরের ইতিহাসে এবার ভোটের দিন মৃত্যুর ঘটল।
সহিংসতায় নিহত আলাউদ্দিনের স্বজনদের আহাজারি। সৌরভ দাশ
চট্টগ্রাম, মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন থেকে সিটি করপোরেশনে রূপান্তরিত হয় ১৯৯০ সালে। এরপর সেখানে মেয়র পদে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৪ সালে। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন। এর পরেরবার ২০০০ সালে বিনা প্রতিদ্বনিদ্বতায় নির্বাচিত হন তিনি। এ দুটি নির্বাচনে কোনো প্রাণহানি হয়নি। ২০০৫ সালে বিএনপি মীর নাছিরের সঙ্গে প্রতিদ্বনিদ্বতা করে আবার জয় পান মহিউদ্দিন। ২০০৫ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল বিএনপি। ওই সময় নির্বাচন ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে চট্টগ্রামের রাজনীতি। ভোটের আগের দিন প্রতিপক্ষের সমর্থকদের হাতে খুন হন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন শ্রমিক লীগের এক কর্মী। ভোটের দিন সহিংসতার আশঙ্কা থাকলেও শেষ পর্যন্ত ভালো ভোটই হয়। এতে জয় পান মহিউদ্দিন।
এরপর ২০১০ সালে ভোট অনুষ্ঠিত হয়। ওই ভোট শান্তিপূর্ণভাবেই অনুষ্ঠিত হয়। মহিউদ্দিন চৌধুরী পরাজিত হন বিএনপির প্রার্থী মনজুরুল আলমের কাছে। ভোটের দিন ফল ঘোষণার সময় সহিংসতা হলেও কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। ২০১৫ সালের নির্বাচনে ছিল কারচুপির অভিযোগ। দুপুরেই ভোট বর্জন করে বিএনপি। তবে সহিংসতা ছিল না।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কাউন্সিল প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মো. আলাউদ্দিন নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। সকাল ১০টার দিকে এ ঘটনা ঘটেছে। নিহত আলাউদ্দিনকে নিজের সমর্থক বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী মাহমুদুর রহমান। ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের ইউসেফ আমবাগান স্কুল কেন্দ্রের বাইরে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী ও বিদ্রোহী প্রার্থী মাহমুদ উল্লাহর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলি হয়। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে এই সংঘর্ষ হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন মো. আলাউদ্দিন।
এই ওয়ার্ডের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী মাহমুদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘সকালে ভোট শুরুর আগে থেকেই ওয়াসিম উদ্দিনের লোকজন বিভিন্ন কেন্দ্র নিজেদের দখলে নিয়েছে। মধ্যরাত থেকে সন্ত্রাসীরা এখানে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মহড়া দিচ্ছে।’ তিনি গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেন, নিহত আলাউদ্দিন তাঁর দলের সমর্থক। প্রচারপ্রচারণার সময় আরও দুজনের মৃত্যু দেখেন নগরবাসী। এর মধ্যে গত ১২ জানুয়ারি পাহাড়তলীতে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে একজনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া করোনার কারণে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থগিতের আগে নির্বাচনী সহিংসতায় আরও একজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থা যেখানে ভালো হওয়ার কথা সেখানে দিন দিন খারাপ হচ্ছে। চট্টগ্রামে এই রক্তক্ষয় নির্বাচন ব্যবস্থার একটা খারাপ নজির তৈরি করলো। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ নিজেদের মধ্যে কোন্দলে জড়াচ্ছে। ভোটে জয় পাওয়া এখন লাভজনক ‘পেশায়’ পরিণত হয়েছে। এ কারণে কেউ হারতে চাইছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা ফেরানো কঠিন হয়ে যাবে।