যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান আর গণতন্ত্র সুরক্ষায় ট্রাম্পের শাস্তি হওয়া জরুরি

প্রশান্তি আন্তজার্তিক ডেক্স ॥ গত ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে হামলা, ভাংচুর, খুন-জখম এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট ও স্পিকারকে হত্যার উদ্দেশ্যে স্লোগান প্রদানে মদদ ও উষ্কে দেয়ার জন্যে কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শাস্তি প্রদানে অনীহা প্রকাশ করে তাহলে ভবিষ্যতে কমান্ডার ইন চীফ কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিনষ্টের পথ বাধাগ্রস্ত করার আশংকা রয়েই যাবে। বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়বে এবং অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী তৎপরতা বাড়তেই থাকবে। এমন অভিমত পোষণের মধ্যদিয়ে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ইউএস সিনেটে ট্রাম্পের দ্বিতীয় অভিশংসন-বিচারে প্রতিনিধি পরিষদের ডেমক্র্যাটরা তাদের বক্তব্যের সারাংশ টেনেছেন। গত বুধবার শুরু হয়েছিল মোট ১৬ ঘণ্টার বক্তব্য উপস্থাপনের পালা। ৯ ইমপিচমেন্ট ম্যানেজার তা বিস্তারিতভাবে উপস্থাপনের সময় ক্যাপিটল হিলে উগ্রপন্থি সমর্থকদের লেলিয়ে দিতে ট্রাম্পের বক্তব্য প্রদর্শন করা হয়। বিভিন্ন টিভিতে প্রচারিত ফুটেজ ছাড়াও হামলায় অংশগ্রহণকারিদের টেলিফোন, ক্যাপিটল হিলের সিসিটিভি, নিরাপত্তা রক্ষীদের ফুটেজ উপস্থাপন করা হয়। কারণ, ৩ নভেম্বরের নির্বাচনের ফলাফল আলোকে ইলেক্টরাল কলেজের ভোটের পর প্রচলিত বিধি অনুযায়ী কংগ্রেসের উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশনে গত ৬ জানুয়ারি সার্টিফাই করা হচ্ছিল সেই রেজাল্ট। ঠিক সে সময়েই ট্রাম্পের সমর্থকরা জঙ্গিরূপ ধারণ করে ক্যাপিটল হিলে হামলা চালিয়েছিল। এবং ঐ জঘন্য অপকর্মের সাক্ষী হচ্ছেন সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য, ট্রাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট, ক্যাপিটল হিলের কর্মকর্তা-কর্মচারি আর নিরাপত্তা রক্ষীরা। তারাই ভিকটিমও ছিলেন। স্মরণ করা যেতে পারে সিনেটের বিচারে জুরিবোর্ডের সদস্য হচ্ছেন ১০০ জন সিনেটর। এতদসত্বেও দলকানা হিসেবে পরিচিত ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টির ৫০ জনের মধ্যে ৪৪ জনই এই বিচারের পক্ষে অবস্থান নেননি। এজন্যেই সমাপনী বক্তব্যে ডেমক্র্যাটরা উপরোক্ত আশংকা প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশ সময় গত শুক্রবার রাত ১১টা থেকে ১৬ ঘণ্টা সময় ধরে ট্রাম্পের আইনজীবীরা অভিযোগ খন্ডন করার যুক্তি উপস্থাপন করবেন। সেজন্যে অধীর আগ্রহে রয়েছে গোটা আমেরিকাসহ গণতান্ত্রিক বিশ্ব। কারণ, যে অপকর্ম সকলেই টিভিতে সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানে প্রত্যক্ষ করেছেন তা খন্ডনে কীভাবে ট্রাম্পের আইনজীবীরা চেষ্টা করবেন সে কৌতুহল সচেতন সকলের মধ্যে। ইমপিচমেন্ট ম্যানেজাররা সংক্ষিপ্তসারে উল্লেখ করেছেন যে, ট্রাম্পই উষ্কে দিয়েছেন ক্যাপিটল হিলে হামলায়। হামলার অবিশ্বাস্য দৃশ্য সরাসরি টিভিতে অবলোকন সত্বেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার সমর্থকদের বিরত হবার আহ্বান জানাননি চার ঘণ্টা পর্যন্ত আর সেই হামলা চালানো হয় ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের উপস্থিতিতে ইলেক্টরাল কলেজের ভোট গণনার সময়। ঐ হামলায় পুলিশ অফিসারসহ ৫ জন নিহত এবং অনেকেই আহত হয়েছেন। হামলার সময়ে ট্রাম্প টুইটে হামলাকারিদের প্রশংসা করেছেন, অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং নির্বাচনে তার বিজয় চুরি করার কথা বারবার বলেছেন। ফলাফল হাইজ্যাকের এহেন কর্মকান্ড রুখে না দিলে যুক্তরাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে বলেও মন্তব্য করেছেন ট্রাম্প। স্মরণ করা যেতে পারে এখন পর্যন্ত ট্রাম্প ঐ নির্বাচনের গণরায়কে মেনে নেননি। ট্রাম্প এখন দায়িত্বে নেই। তিনি নিতান্তই একজন সাধারণ নাগরিক। তাই ইউএস সিনেটে এই বিচার চলতে পারে না বলে রিপাবলিকান পার্টির ৪৪ সিনেটর উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ দায়িত্বে থাকার সময়ের অপকর্মের বিচার হোয়াইট হাউস ত্যাগের পর করার এখতিয়ার ইউএস সিনেটকে সংবিধান দিয়েছে কিনা তা যাচাইয়ে অনুষ্ঠিত ভোটে ৫০ রিপাবলিকানের ৪৪ জনই সায় দেননি। মাত্র ৬ সিনেটর ডেমক্র্যাটিক পার্টির ৫০ সিনেটরের সাথে যুক্ত হওয়ায় বিচার শুরুর পথ সুগম হয়েছে। তবে মূল বিচারে ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করতে হলে ৬৭ ভোটের প্রয়োজন। কিন্তু ১৭ রিপাবলিকান সিনেটরের ভোট পাবার কোন সম্ভাবনা এখনও তৈরী হয়নি বলেই শেষ পর্যন্ত ট্রাম্পকে সামনের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার প্রত্যাশা অপূর্ণই থেকে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। অথচ ডেমক্র্যাটদের মতোই রিপাবলিকানরাও আক্রান্ত হয়েছিলেন ঐ হামলায়। ট্রাম্পের রানিংমেট মাইক পেন্সকে ফাঁসিতে ঝুলানোর জন্যে ক্যাপিটল হিলের সামনে একটি মঞ্চও করা হয়েছিল।
এমন অপরাধের বিচার যদি দলীয় আনুগত্যের কারণে ভেস্তে যায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চরম হুমকির মুখে পড়তে বাধ্য এবং আন্তর্জাতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের যে সুনাম ছিল তাও অটুট রাখা একেবারেই সম্ভব হবে না বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞরা অভিমত পোষণ করেছেন। আরো হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে যে, ক্যাপিটল হিলে হামলায় মদদদানকারি ট্রাম্পের বিচারের পাশাপাশি ইতিমধ্যেই যারা গ্রেফতার হয়েছে, তাদেরকেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। অন্যথায় অভ্যন্তরীণ চরমপন্থি দমন করা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা। ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করা সম্ভব না হলে ২০২৪ সালের নির্বাচনে তিনি আবারো প্রার্থী হতে পারবেন। তাহলে চরমপন্থি সমর্থকরা সামাজিক অস্থিরতা তৈরী করে আবারো ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট বানাতে মরিয়া হয়ে উঠবে এবং তা কোনভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের চেতনা আর মূল্যবোধকে জাগ্রত রাখার পরিপূরক হবে না বলে সচেতন মহল মনে করছেন। ট্রাম্পের আইনজীবীরা শনিবারের মধ্যেই তাদের যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনে সক্ষম হলে বাংলাদেশ সময় গত সোমবার সকালের মধ্যে রায় প্রদানের কাজ সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, এক মেয়াদের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এটি দ্বিতীয় অভিশংসনের ট্রায়াল। এর আগে আর কোন প্রেসিডেন্টকেই দু’বার ইমপিচের মুখোমুখী হতে হয়নি। এছাড়া, আড়াই শত বছরের মধ্যে আর কখনোই ক্যাপিটল হিলে ভোটের ফলাফল সার্টিফাইয়ের সময় এমন জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেনি। ট্রায়ালে সভাপতিত্ব করছেন ভারমন্টের সিনেটর প্যাট্রিক লেহী (ডেমক্র্যাট)। ডেমক্র্যাট প্রতিনিধি পরিষদের ইমপিচমেন্ট-ম্যানেজারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ম্যারিল্যান্ডের কংগ্রেসমান জেমি রাস্কিন।
স্পিকার ন্যান্সি পেলসির মনোনীত অপর ম্যানেজাররা হলেন টেক্সাসের যোয়াকিন ক্যাস্ত্রো, রোড আইল্যান্ডের ডেভিড সিসিলিন, পেনসিলভেনিয়ার মেডেলিন ডীন, কলরাডোর ডায়ানে ডিজেটি, ক্যালিফোর্নিয়ার টেড ল্যু, কলরাডোর জো নিগোস, ভার্জিন আইল্যান্ডে স্ট্যাসি প্লাসকেট এবং ক্যালিফোর্নিয়ার এরিক সোয়ালওয়েল। ইমপিচমেন্টের পক্ষে ৫২% আমেরিকানএক বছর আগের তুলনায় ৬% বেশী মানুষ ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করার পক্ষে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রথম ইমপিচমেন্ট ট্রায়াল অনুষ্ঠিত হয়েছে ইউএস সিনেটে। সে সময় রিপাবলিকানরা তাকে রক্ষা করেছেন। চলমান ট্রায়ালের সময়েই গ্যালাপ জরিপে ৫২% আমেরিকান বলেছেন যে, তারা ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করার পক্ষে। ট্রাম্পকে অভিশংসিত করার বিপক্ষে রয়েছেন ৪৫%। অর্থাৎ সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করার এখতিয়ার যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান দেয়নি বলে রিপাবলিকান পার্টির ৪৪ সিনেটরের সাথে তারা একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। প্রথম ইমপিচমেন্ট ট্রায়াল চলার সময়ে গ্যালপ জরিপে অংশগ্রহণকারি আমেরিকানদের ৪৬% ট্রাম্পের শাস্তি চেয়েছিলেন। ট্রাম্পের বিচারের বিরোধিতা করেছিলেন সে সময় ৫১% আমেরিকান। এবারের জরিপ চালানো হয় ২১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এবং অংশ নেন ৯০৬ জন প্রাপ্ত বয়স্ক আমেরিকান।

Leave a Reply

Your email address will not be published.