বা আ ॥ করোনাভাইরাসের গণ টিকাদানের দ্বিতীয় দিনে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে টিকা গ্রহীতাদের উপস্থিতি বেড়েছে। অনেক প্রবীণ স্বজনদের সঙ্গে এসে টিকা নিয়ে বলেছেন, প্রাণঘাতী এই ভাইরাস থেকে এখন নিরাপদ বোধ করছেন তারা। দ্বিতীয় দিন গত সোমবার সকাল ৮টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত টিকা দেওয়া হয়। করোনাভাইরাস মোকাবেলার সম্মুখযোদ্ধাদের সঙ্গে বয়সে প্রবীণ ও মুক্তিযোদ্ধাসহ কয়েকটি শ্রেণির নাগরিকরা প্রথম দিকে টিকা পাচ্ছেন। রাজধানীর ডজনখানেক হাসপাতাল ও টিকাদান কেন্দ্র ঘুরে উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়েই মানুষকে টিকা নিতে দেখা গেছে। এদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে আটটি বুথ থেকে করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া হয়। নারীদের জন্য রাখা হয় আলাদা বুথ।
সকালে টিকাদান চলার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ রফিকুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আজকে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। সবাই সুশৃঙ্খলভাবে টিকা নিচ্ছে। অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি, ডায়াবেটিস রোগী টিকা নেওয়ায় মানুষের মাঝে ভয় ও জড়তা কেটে গেছে। প্রতি বুথে ১৫০ জন করে আটটি বুথে ১২০০ জনকে টিকা দেওয়ার প্রস্তুতি আছে। রেজিস্ট্রেশনের জন্য আলাদা বুথ আছে। স্বেচ্ছাসেবকরা শৃঙ্খলা বজায় রাখছে। ভ্যাকসিন নেওয়ার পর বিশ্রামের ব্যবস্থা আছে।” স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত ৮৪ বছর বয়সী চিকিৎসক ডা. এএইচএম তৌহিদুল আনোয়ার চৌধুরী (ডা. টিএ চৌধুরী) সকালে এখান থেকে টিকা নেন। তিনি বলেন, “টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে বয়স কোনো বিষয় নয়। বয়স কিংবা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার চিন্তা না করে সবারই টিকা নেওয়া উচিত। একথা প্রমাণিত যে, টিকা প্রটেকশন দেয়। কতদিন দেয় বা কতক্ষণ থাকবে, এটা আমরা জানি না। কিন্তু প্রটেকশন দেবে, এটা নিশ্চিত। যাদের বয়স বেশি, যারা ভালনারেবল তাদের সবার টিকার আওতায় আসা উচিত।” স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগীত শিল্পী রফিকুল আলম ও তার স্ত্রী আবিদা সুলতানাও এদিন টিকা নেন। টিকা নেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী ধন্যবাদ জানান রফিকুল আলম। তিনি বলেন, সরকার ‘অত্যন্ত চমৎকার ব্যবস্থাপনায়’ টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনা করছে। “আমি ছোটবেলা থেকে অনেক টিকা নিয়েছি। তখন তো টিকা নেওয়া অনেক কষ্টকর ছিল- ঘা হয়ে যেত, ইনফেকশন হয়ে যেত। আজকে ভ্যাকসিন নেওয়ার পর কোনো প্রতিক্রিয়া অনুভূত হল না। মাত্র ৩-৮ সেকেন্ড লাগে। ভয় পাওয়ার কোনা কারণই দেখছি না।”
কণ্ঠশিল্পী আবিদা সুলতানা বলেন, “টিকা নিয়ে নিজেকে অনেক হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে, অনেক বড় একটা বোঝা নেমে গেল। কোনো টেনশনের কারণ নেই। কোনো ব্যাথাও পাইনি।” মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান এবং তার স্ত্রীও সকালে এখান থেকে টিকা নেন। সবাইকে টিকা নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে মতিউর রহমান বলেন, “করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষার জন্য টিকার বিকল্প নেই। আমরা যারা সংবাদমাধ্যমে কাজ করি, তাদের টিকা নেওয়া জরুরি। টিকা নিতে হবে সবাইকেই। আমি টিকা নিলাম, আর আপনি নিলেন না, তাতে কিন্তু আমরা নিরাপদ ভাবতে পারি না।”বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে টিকা নিতে রাজাবাজার থেকে আসেন ৭০ বছর বয়সী ফজলুল করিম। তিনি বলেন, “ভেবেছিলাম টিকা দিলে কী যেন হয়। এই বয়সে আরও অনেক রোগ-ব্যাধি নিয়ে টিকা নেওয়া নিরাপদ হবে কি না? আসলে টিকা নেওয়ার পর ভালোই লাগছে। নিজের মধ্যে একটু সাহস পাচ্ছি। করোনা থেকে কিছুটা হলেও নিরাপদ মনে হচ্ছে।” প্রথম দিনের চেয়ে সোমবার টিকা গ্রহীতাদের উপস্থিতি বেশি ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও। হাসপাতালের উপ-পরিচালক আলাউদ্দিন আল আজাদ জানান, তাদের এখানে টিকা দেওয়া শুরুর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে প্রায় একশ জন টিকা নিয়েছেন। সকালে টিকা নেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ খান আবুল কালাম আজাদ। এই হাসপাতালের একটি বুথে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাসমিনা পারভীন বলেন, “আগের দিনের চেয়ে বেশি মানুষ টিকা নিতে এসেছে।”
গত রোববার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৭০ জন নাগরিক টিকা নিয়েছেন। গত সোমবার এই সংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করেন চিকিৎসক তাসমিনা পারভীন। আলাউদ্দিন আল আজাদ জানান, রেজিস্ট্রেশন করে টিকা কার্ড আনলেই তাদের এখান থেকে টিকা দেওয়া হচ্ছে, এসএমএসের প্রয়োজন নেই।রাজধানীর মহাখালীর জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে বেলা সোয়া ১২টা পর্যন্ত পাঁচটি বুথে ৭৮ জন টিকা নেন। তাদের একজন আফতাবনগর এলাকার বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আবুল হোসেন। বেলা সাড়ে ১১টায় টিকা নিয়ে বিশ্রাম করছিলেন তিনি। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস থেকে সুস্থ থাকার জন্য টিকা নিয়েছেন তিনি। “এটা তো সাধারণ বিষয়। আমি এমনিতেই অসুস্থ। কিন্তু টিকা নেওয়ার মতো অবস্থা আছে। এ কারণে টিকা নিয়েছি। এই বয়সে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হলে তো বিপদ।” মধ্য বাড্ডা থেকে পারভীন সরকার গীতাকে নিয়ে আসেন তার মেয়ে শর্মিলা রায়। শর্মিলা বলেন, “টিকা নিলে তিনি সুস্থ থাকবেন এবং বাকিরা নিরাপদ থাকবে। এ কারণে নিয়ে এসেছি।” পারভীন সরকার গীতা জানান, টিকা নিয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তার। “অন্য সময় ইনজেকশন নিলে যেমন, এখনও তেমন লাগছে। অস্বাভাবিক কিছু মনে হচ্ছে না, খারাপ লাগছে না।”মহাখালীরই আরেক সরকারি হাসপাতাল শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পাঁচটি বুথে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত ৮২ জন টিকা নেন। এখান থেকে টিকা নিতে মোবাইলে বার্তা পাঠানো হয়েছিল ১২৬ জনকে। গণটিকা কর্মসূচীর দ্বিতীয় দিন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চারটি বুথে টিকা দেওয়া হয়েছে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ ডা. শাহাদত হোসেন জানান, এই হাসপাতালে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা- কর্মচারীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ টিকা নিচ্ছেন। প্রথমদিন এই হাসপাতালে চার হাজার নিবন্ধন করেছেন। তাদের মধ্যে ২০০ জনকে মোবাইলে বার্তা পাঠানো হয়েছে।
প্রথম দিন টিকা দেওয়া হয়েছে ১২৬ জন পুরুষ এবং ৭৭ জন নারীকে। “হাসপাতালে এসে নিবন্ধন করার ক্ষেত্রে সাময়িক কিছটা সমস্যা হচ্ছে। বর্তমানে চারটি বুথে টিকা দেওয়া হচ্ছে। ১০টি বুথ করার পরিকল্পনা রয়েছে। চাপ বাড়লে বাকী বুথগুলো খোলা হবে। প্রতিদিন এক হাজার জনকে টিকা দেওয়া যাবে।”সকাল ১০টার পর শ্যামলীর ২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতালে টিকা নিতে আসেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। এ সময় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুমও করোনাভাইরাসের টিকা নেন। টিকা নিয়ে সাধন চন্দ্র মজুমদার সাংবাদিকদের জানান, স্বাভাবিক আছেন তিনি। টিকা নিয়ে একটি পক্ষ অপপ্রচার চালাচ্ছে মন্তব্য করে সরকারের এই মন্ত্রী বলেন, “মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে অপপ্রচার চলছে। জনগণকে বাঁচাতে ভ্যাকসিন, মেরে ফেলার জন্য নয়। শুরুতে এক পক্ষ বলেছে, ভ্যাকসিন আসবে না। আসার পর বলেছে, নেওয়া যাবে না। বিরোধী দল বলেছে, এমপি-মন্ত্রী নিলে আস্থা আসবে। তাই আমরা নিয়েছি।” প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মশিউর রহমান হুমায়ূন, প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল অফিসার শামিম মুশফিক, প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব-২ গাজী হাফিজুর রহমান লিকু বেলা আড়াইটার দিকে রাজধানীর নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে টিকা নেন। মশিউর রহমান হুমায়ূন বলেন, “অত্যন্ত উৎসব মুখর পরিবেশে আজ ভ্যাকসিন গ্রহণ করলাম। কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।” প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী এবং তার স্ত্রী আসমা চৌধুরী সকালে ঢাকা সিএমএইচে গিয়ে টিকা নেন বলে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও করোনাভাইরাসের টিকা নেওয়ার আগ্রহ বেড়েছে। সচিবালয় ক্লিনিকে এদিন সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত টিকা দেওয়া হয়। সেখানকার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াস চৌধুরী বলেন, “ক্লিনিকে বর্তমানে ৩০০ জনকে টিকা দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে। গক সোমবার ২৫৭ জনকে টিকা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১১৯ জন পুরুষ এবং ৩৮ জন মহিলা।” এই ক্লিনিকে টিকা নিতে নিবন্ধিতদের মধ্যে প্রথম দিন ২০০ জনকে টিকা দেওয়ার কথা ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রথম দিন টিকা নেওয়া ১৬৭ জনের মধ্যে ১৪৯ জন পুরুষ ও ১৮ জন ছিলেন মহিলা। গত রোববারের তুলনায় সোমবার টিকা নিতে আসা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আগ্রহ বেশি দেখা গেছে। অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী ক্লিনিকে এসে খোঁজ নিয়ে যাচ্ছেন এবং কীভাবে টিকা নেবেন এ বিষয়ে বিস্তারিত জেনে যাচ্ছেন।” সকালে সচিবালয় ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়, সবাই নিবন্ধনের কাগজ সঙ্গে নিয়ে টিকা নিতে আসছেন। তা যাচাই-বাছাই করে তাদের দিচ্ছিলেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। দুটি বুথ থেকে টিকা দেওয়া হয়। ডা. ইলিয়াস চৌধুরী জানান, টিকা গ্রহীতাদের কারও তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। “প্রথম দিন একজন এবং সোমবার দুইজনের টিকা দেওয়ার স্থানে কিছুটা ফুলে গেছে। এটি তেমন কোনো সমস্যা নয়। এছাড়া এ ক্লিনিকে থেকে যারা টিকা নিয়েছেন পরবর্তীতে কোনো সমস্যার বিষয়ে তথ্য আসেনি।”
তথ্য অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা পরীক্ষিৎ চৌধুরী বলেন, “দুপুরে টিকা নিয়েছি, টিকা নেওয়ার পর কোনো ধরনের সমস্যা মনে হচ্ছে না। একেবারে স্বাভাবিক আছে।” বিকেলে সচিবালয় ক্লিনিকে উপস্থিত সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অফিস সহকারী সজল আফজাল বলেন, “কীভাবে টিকা নিতে হবে এ বিষয়টি জানান জন্য ক্লিনিকে এসেছি, আগামীকাল বা পরশু টিকা নেওয়ার ইচ্ছা আছে।” অধিকাংশ কেন্দ্রে টিকা গ্রহীতাদের উপস্থিতি আগের চেয়ে বাড়লেও কিছু কিছু কেন্দ্রে তুলনামূলক কম ছিল। তার একটি আজিমপুরের মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৩ টা পর্যন্ত ৪০ জন নেন। প্রতিষ্ঠানটির উপসহকারী মেডিকেল অফিসার ফিরোজ আলম বলেন, উপস্থিতি কম থাকায় কিছুটা বিড়ম্বনাও হয়েছে তাদের।কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “একটা ভায়ালে যে টিকা থাকে তাতে ১০ জনকে টিকা দেওয়া যায়। ফলে একটি ভায়াল তখনই খোলা যায় যখন একসাথে কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ জন উপস্থিত থাকে। ৪০ জনের জন্য আজকে চারটি ভায়াল খোলা হয়েছে। ১০ জনের কম হওয়ায় শেষ মুহূর্তে টিকা না নিয়েই ফিরতে হয়েছে চারজনকে।” মগবাজার থেকে পুত্রবধূর সাথে এখানে টিকা নিতে আসেন ৭১ বছর বয়সী কামরুন্নাহার বেগম। তিনি বলেন, “টিকা নিয়ে ভয় ছিল, কিন্তু আমার এক পরিচিত ডাক্তারের সাথে কথা বলার পর ভয়টা দূর হয়েছে। করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে টিকা তো নিতেই হবে।” এই কেন্দ্রে সকালে টিকা নেন ৭৭ বছর বয়সী হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, “এখানে মানুষ কম হওয়ায় ঝামেলাও কম ছিল, এখানকার কর্মীরাও অনেক সহযোগিতা করেছেন। ভালোই লাগছে। যা নিয়ে এত আলোচনা, তার জন্যই আসলাম আজকে।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৭ জানুয়ারি ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। সে সময় দুই দিনে মোট ৫৬৭ জনকে টিকা দেওয়া হয়। বাংলাদেশে এই টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ না হওয়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী তাদের এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণ করা হয়। কারও মধ্যে গুরুতর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা না দেওয়ায় পরিকল্পনা মত রোববার গণ টিকাদান শুরু হয়। গত রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিকেলে ইনফরমেশন সার্ভিসেস বিভাগ (এমআইএস) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, যারা টিকা নিয়েছেন তাদের মধ্যে ২১ জনের ‘সামান্য উপসর্গ’ দেখা যাওয়া ছাড়া বড় কোনো সমস্য হয়নি।প্রথম দিন ঢাকার অনেক কেন্দ্রে বিকাল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত টিকা দেওয়া হলেও গত সোমবার থেকে সাপ্তাহিক ছুটি বাদে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত টিকা দেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, প্রথম দিন ৩১ হাজার ১৬০ জন করোনাভাইরাসের টিকা নেন। তাদের মধ্যে ২৩ হাজার ৮৫৭ জন পুরুষ এবং ৭ হাজার ৩০৩ জন নারী। রোববার ঢাকা মহানগরে টিকা নেন ৫ হাজার ৭১ জন। ঢাকার ৪৭টি কেন্দ্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫৬০ জন টিকা নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে।
আর বিভাগভিত্তিক হিসাবে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি ৯ হাজার ৩১৪ জন টিকা নেন ঢাকা বিভাগে। এছাড়া ময়মনসিংহে ১ হাজার ৬৯৩ জন, চট্টগ্রামে ৬ হাজার ৪৪৩ জন, রাজশাহীতে ৩ হাজার ৭৫৭ জন, রংপুরে ২ হাজার ৯১২ জন, খুলনায় ৩ হাজার ২৩৩ জন, বরিশালে ১ হাজার ৪১২ জন এবং সিলেট বিভাগে ২ হাজার ৩৯৬ জন টিকা নেন। প্রাথমিকভাবে ঢাকাসহ সারা দেশে ১০১৫টি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। ঢাকায় ২০৪টি এবং ঢাকার বাইরে ২ হাজার ১৯৬টি স্বাস্থ্যকর্মীদের দল এসব কেন্দ্রে সরাসরি টিকাদানে নিয়োজিত রয়েছেন। ধারাবাহিকভাবে করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে মোট ৭ হাজার ৩৪৪টি দল প্রস্তুত করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, প্রতিটি দল দৈনিক ১৫০ জনকে টিকা দিতে পারবে। সে হিসেবে দৈনিক তিন লাখের বেশি মানুষকে টিকা দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগের। টিকা নিতে আগ্র্রহী সবাইকেই আগে নিবন্ধন করতে হচ্ছে। গত রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত টিকার জন্য চার লাখের বেশি মানুষ নিবন্ধন করেছেন বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে। বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও প্রস্তুতি পরিকল্পনা অনুযায়ী, তিন ভাগে (ফেইজ) মোট পাঁচ ধাপে এসব টিকা দেওয়া হবে। কোভিড-১৯ মহামারী প্রতিরোধে সামনের কাতারে থাকা মানুষ প্রাধান্য পাবেন। প্রাথমিকভাবে সেখানে ১৯টি শ্রেণিতে নিবন্ধন করার সুযোগ রাখা হয়। এর মধ্যে একটি শ্রেণি ৫৫ বছরের বেশি বয়সী নাগরিকদের জন্য। বাকিগুলো সম্মুখসারিতে থাকা বিভিন্ন পেশাভিত্তিক শ্রেণি অথবা বিশেষ শ্রেণির জন্য। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনাভাইরাসের টিকা বাংলাদেশে দেওয়া হচ্ছে। সবাইকে এ টিকার দুটি ডোজ নিতে হবে।
এই টিকার তিন কোটি ডোজ পেতে সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে বাংলাদেশের, যার মধ্যে ৫০ লাখ ডোজ হাতে পাওয়ার পর জেলায় জেলায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে আগেই। এছাড়া ভারত সরকারের উপহার হিসেবে পাওয়া গেছে আরও ২০ লাখ ডোজ টিকা। এই টিকা নিরাপদ এবং করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কার্যকর বলে প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়েছে যুক্তরাজ্যের ওষুধ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ। ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, চীন, রাশিয়া, জার্মানিসহ বিশ্বের ৫৩টি দেশ বাংলাদেশের আগে টিকার প্রয়োগ শুরু করে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত অনেক দেশে এখনও টিকার প্রয়োগ শুরু হয়নি। সে হিসেবে তৃতীয় বিশ্বের দেশ বাংলাদেশে প্রথম দিকেই টিকাদান কার্যক্রম শুরুর ঘটনা অনন্য, ঐতিহাসিক। টিকা নিয়ে এতদিন যারা সরকারের সমালোচনা করে আসছিলেন, প্রথম দিনে তাদের কয়েকজনও টিকা নিয়েছেন। তাদের একজন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে টিকা নিয়ে জনসাধারণকে আশস্ত করে তিনি বলেন, ‘আমি বলব, টিকা নিন সবাই- কোনো ভয় নাই। টিকা আপনার অধিকার। যার যেদিন সময় হবে, টিকা নিয়ে নেবেন।’ টিকা নিয়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর এই বক্তব্য ইতিবাচক বলে মনে করছেন অনেকে। তাদের অভিমত, টিকা নিয়ে সরকারের সমালোচনায় থাকা ব্যক্তিদের ইতিবাচক বক্তব্য জনমনে প্রভাব ফেলবে। এতে টিকা নিতে সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়বে। একই সঙ্গে টিকাদান কর্মসূচি নিয়ে সরকারের সামনে যে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছিল, তা অতিক্রমেও গতি বাড়বে।
প্রথম দিনে টিকা নিয়েছেন সরকারের সাত মন্ত্রী, তিন প্রতিমন্ত্রী, একজন উপমন্ত্রী, একজন হুইপ, ১৫ জন এমপি, প্রধান বিচারপতিসহ ৪৭ বিচারপতি ও চার সচিব। এ ছাড়া প্রথম দিনেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিভিন্ন বাহিনী, পুলিশ ও চিকিৎসক নেতা, স্বাস্থ্য বিভাগের বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তি থেকে শুরু করে বরেণ্য ব্যক্তিদের অনেকের অংশ নেওয়াও ছিল উৎসাহব্যঞ্জক। টিকা নেওয়ার পর তারা সবাই সুস্থ আছেন- এই বার্তায় টিকা নিয়ে জনমনের ভীতি অনেকটাই দূর হয়েছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, প্রথম দিনে সারাদেশে টিকা নিয়েছেন ৩১ হাজার ১৬০ জন। তাদের মধ্যে পুরুষ ২৩ হাজার ৮৫৭ এবং নারী সাত হাজার ৩০৩ জন। তাদের মধ্যে ২১ জনের শরীরে সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। তাদের শরীরে সামান্য জ্বর রয়েছে। এর আগে ২৭ জানুয়ারি ২৬ জন এবং ২৮ জানুয়ারি ৫৪১ জন টিকা নেন। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত টিকা নিয়েছেন ৩১ হাজার ৭২৭ জন। টিকাদান কার্যক্রম নিয়ে বিভিন্ন স্থানে কিছু কিছু অব্যবস্থাপনার ঘটনা ঘটেছে; অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে কয়েকটি স্থানে। তবুও সব মিলিয়ে দিনটি ছিল উৎসবমুখর। এ যেন আঁধার কাটিয়ে আলোর পথে যাত্রা।