বা আ ॥ করোনাভাইরাসের টিকা পেয়ে উচ্ছ্বসিত খুলনার কয়রা উপজেলার সুন্দরবন সংলগ্ন হাতিয়ারডাঙ্গা গ্রামের সবিতা রানী সানা। গত রোববার স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তিনি ও তার স্বামী টিকা নেন। সবিতা বলেন, করোনাভাইরাসের টিকা নিয়ে বিভিন্ন দেশে মানুষের অসুস্থতার খবরে তারা ভীত ছিলেন। এ কারণে প্রথমে টিকা নেওয়ার সাহস পাননি। কিন্তু দেশের লাখ লাখ মানুষ টিকা নেওয়ার পরও সুস্থ আছেন। তাই তাদের মনোবল বেড়েছে। তাই ছেলেকে দিয়ে নিবন্ধন করে টিকা নিয়েছেন। টিকা নেওয়ার পর তারা দু’জনেই সুস্থ আছেন। সবিতার মতোই দেশব্যাপী মানুষের মধ্যে টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে যে সংশয়, ভয়ভীতি ছিল তা কেটে গেছে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে উপজেলা শহর পর্যন্ত কেন্দ্রে কেন্দ্রে টিকা নিতে মানুষের ভিড় বেড়েছে। প্রত্যেকটি টিকাকেন্দ্র যেন উৎসবস্থলে পরিণত হয়েছে। টিকা নিয়ে হাসিমুখে বাড়িতে ফিরছে মানুষ। টিকা নিয়ে কুমিল্লা নগরীর বাসিন্দা জসিম উদ্দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, শুরুতে টিকা পাওয়া নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছিল। টিকার মান নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ানো হয়েছিল। টিকা নিয়ে মানুষ অসুস্থ হচ্ছে, মারা যাচ্ছে- এমন গুজবের কারণে শুরুতে তারা ভয়ে ছিলেন। কিন্তু দেশে লাখ লাখ মানুষ টিকা নেওয়ার পরও সুস্থ থাকার খবরে তাদের ভয় কেটে গেছে। এরপর গত তিনিও টিকা নিয়েছেন। টিকা নিয়ে সুস্থ আছেন জানিয়ে জসিম উদ্দিন বলেন, তার মতো অধিকাংশ মানুষের টিকা নিয়ে ভয় কেটে গেছে। এ কারণে টিকাকেন্দ্রে আগ্রহী মানুষের ভিড় বাড়ছে। এই মানুষের চাপ সামলাতে টিকাকেন্দ্র আরও বাড়ানো প্রয়োজন। একই সঙ্গে টিকাকেন্দ্রে তাৎক্ষণিক নিবন্ধন আবারও চালুর করা দাবি জানান তিনি। তবে গণটিকাদান কর্মসূচির সফলতা নিয়ে খোদ সরকারই সংশয়ে ছিল। কারণ শুরুতে টিকা গ্রহণে মানুষ তেমন আগ্রহী ছিলেন না। টিকার নিবন্ধন ওয়েবসাইটেও তেমন সাড়া মিলছিল না। এ কারণে প্রতিদিন দুই লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেও তা থেকে পিছু হটে স্বাস্থ্য বিভাগ। টিকাদান পরিকল্পনায় আনা হয় পরিবর্তন। আগের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে প্রতিদিন এক লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার নতুন পরিকল্পনা করা হয়। কর্মসূচি শুরুর দু’দিনের মাথায় টিকা গ্রহীতার সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে যায়। এরপর এক দিন দুই লাখও অতিক্রম করে। সরকারি ছুটির দিন গত শুক্রবার টিকাদান কার্যক্রম বন্ধ ছিল। গত সোমবার পর্যন্ত নয় দিনে সারাদেশে ১১ লাখ ৩২ হাজার ৭১১ জন টিকা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে পুরুষ সাত লাখ ৭৩ হাজার ৬২৪ জন। এবং নারী তিন লাখ ৫৯ হাজার ৮৭ জন।
প্রতিদিন গড়ে এক লাখ ২৯ হাজার ৪৩৩ জন করে টিকা নিয়েছেন। এ চিত্র থেকে বলা যায়, টিকাদান কর্মসূচিতে মানুষের স্বতঃস্ম্ফূর্ত সাড়া মিলেছে। টিকাকেন্দ্রের উপচে পড়া ভিড় সামলাতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হিমশিম খাচ্ছে। ভিড় সামলাতে টিকাকেন্দ্রে আপাতত নিবন্ধন স্থগিত করা হয়েছে। তবে স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, প্রয়োজনে টিকাকেন্দ্রে আবারও নিবন্ধন শুরু করা হবে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশজুড়ে টিকা নেওয়াদের মধ্যে পুরুষ রয়েছেন এক লাখ ৪৭ হাজার ১৫৫ জন। আর নারী ৭৯ হাজার ৫২৩ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা মহানগরে টিকা নিয়েছেন ২৯ হাজার ৫৫ জন। আর পুরো ঢাকা বিভাগে নিয়েছেন ৬২ হাজার ৭৩৩ জন। এছাড়া ময়মনসিংহ বিভাগে নিয়েছেন নয় হাজার ৪৫৫ জন, চট্টগ্রামে নিয়েছেন ৫২ হাজার ৭৪৪ জন, রাজশাহীতে ২৪ হাজার ৬০ জন, রংপুরে নিয়েছেন ২১ হাজার ৬১৮ জন, খুলনায় ২৭ হাজার ৭১০ জন, সিলেটে ১৬ হাজার ২২৭ জন এবং বরিশালে টিকা নিয়েছেন ১২ হাজার ১৩১ জন। এই নয়দিনে ময়মনসিংহে টিকা নিয়েছেন মোট ৪০ হাজার ৭৩০ জন, চট্টগ্রামে নিয়েছেন দুই লাখ ৭০ হাজার ৯৫৯ জন, রাজশাহীতে এক লাখ ২৮ হাজার ৭৬৩ জন, রংপুরে এক লাখ ছয় হাজার ৬৩৪ জন, খুলনায় এক লাখ ২৮ হাজার ১৫৯ জন, সিলেটে ৯৩ হাজার ২৩৮ জন এবং বরিশালে টিকা নিয়েছেন ৫১ হাজার ৫২৩ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় বান্দরবান জেলায় টিকা নিয়েছেন ৩৫৬ জন। এছাড়া শরীয়তপুরে টিকা নিয়েছেন ৮৯৬ জন। জয়পুরহাটে টিকা নিয়েছেন এক হাজার ২৩০ জন। পাশাপাশি লালমনিরহাটে টিকা নিয়েছেন এক হাজার ৪১ জন, মেহেরপুর জেলায় ৯৭৯ জন, সুনামগঞ্জে এক হাজার ৮৯ জন এবং ঝালকাঠিতে এক হাজার ১৯ জন।খুলনায় টিকা গ্রহীতাদের ভিড় : খুলনা ব্যুরো ও কয়রা সংবাদদাতা জানান, খুলনায় গত রোববার পর্যন্ত করোনার টিকা নিয়েছেন মোট ২৬ হাজার ১৮৬ জন। এর মধ্যে খুলনা সিটি করপোরেশন এলাকায় নিয়েছেন ১৩ হাজার ৯৮৫ জন এবং জেলার নয়টি উপজেলায় নিয়েছেন ১২ হাজার ২০১ জন। শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে টিকার প্রতি আগ্রহ কিছুটা কম। সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেল্গক্স সূত্রে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বাইরে যারা টিকা গ্রহণ করেছে তাদের অধিকাংশই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। সাধারণ মানুষের মধ্যে এ পর্যন্ত ৬৫ জনের মতো টিকা নিয়েছেন। তবে টিকা নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে। কয়রা উপজেলার মসজিদকুড় গ্রামের কৃষক জুলফিকার আলী বলেন, ‘শুনেছি টিকা নিতি হলি আগে নাম লেখাতি (নিবন্ধন) হবে। নাম লেখানোর জন্যি কয়েকবার ইউনিয়ন পরিষদের তথ্য সেবা কেন্দ্রে গিয়েছি। কিন্তু লেখাতি পারিনি। নাম লিখাতি পারলেই টিকা নিব।’ কয়রা সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ আমিরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, নিবন্ধন জটিলতা না থাকলে অনেকেই টিকা নিতে আগ্রহী হতেন। কেন্দ্রে কেন্দ্রে নিবন্ধন করে টিকাদান শুরু করা হলে আরও বেশি মানুষ আগ্রহী হবেন।যশোরে বিপুল সাড়া : যশোর অফিস জানায়, সেখানে টিকাদান কার্যক্রম চলছে নির্বিঘ্নে। টিকা গ্রহণকারীর সংখ্যাতেও রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। এ পর্যন্ত জেলায় ১২ হাজার ৬৩৫ জন টিকা গ্রহণ করেছেন। এটা খুলনা বিভাগের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। তবে স্পট রেজিস্ট্রেশন বন্ধ করায় টিকা গ্রহণের হার কিছুটা কমতে পারে বলে মনে করছে সংশ্নিষ্টরা। যশোর রোগী কল্যাণ সমিতির নেতা আব্দুল মুনাফ দিলু বলেন, টিকাদান কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে স্পট রেজিস্ট্রেশন বন্ধ করাটা ভালো হয়েছে। স্পটে না হলেও তাদের সংস্থাসহ বিভিন্ন সংগঠন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কাজটি চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।যশোরের সিভিল সার্জন ডা. শেখ আবু শাহীন জানান, জেলায় টিকাদান কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছে। কারও মধ্যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার খবর পাওয়া যায়নি। তাছাড়া এখন মানুষ গুজব ও অপপ্রচারেও কান দিচ্ছে না। ফলে টিকাকেন্দ্রে প্রতিদিন ভিড় বাড়ছে।কুমিল্লায় ভয় কেটে গেছে : কুমিল্লা সংবাদদাতা জানান, সেখানে প্রতিদিনই টিকাকেন্দ্রে ভিড় বাড়ছে। টিকাদান কর্মসূচির প্রথম দিন জেলায় টিকা নিয়েছিলেন এক হাজার ৯১ জন। সপ্তম দিনে গত রোববার টিকা নিয়েছেন ছয় হাজার ২১৫ জন। জেলার নাঙ্গলকোট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. দেবদাস দেব সমকালকে বলেন, গুজব ও অপপ্রচারের কারণে মানুষ প্রথম দিকে করোনার টিকা নিতে ভয় পেত। তাদের উপজেলায় প্রথম দিন টিকা নিয়েছিল ২৭ জন আর দ্বিতীয় দিন মাত্র ২০ জন। কিন্তু মানুষ যখন দেখল টিকা নিলে কোনো সমস্যা হচ্ছে না, তখন থেকে সবাই দলে দলে টিকা নিতে আসছে। নাঙ্গলকোট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২২৬ জন টিকা নিয়েছেন।জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান জানান, কুমিল্লায় এ পর্যন্ত টিকা নিয়েছেন ৩৩ হাজার ৮৯৫ জন। শুধু গত রোববার টিকা গ্রহণ করেছেন ছয় হাজার ২১৫ জনের যাদের মধ্যে ৪১২৮ জন পুরুষ এবং ২১৮৭ জন নারী। প্রতিদিনই বাড়ছে টিকা গ্রহীতাদের সংখ্যা। কিশোরগঞ্জে কেন্দ্রে কেন্দ্রে উৎসব : কিশোরগঞ্জ অফিস জানায়, কিশোরগঞ্জে টিকাকেন্দ্রগুলো উৎসবস্থলে পরিণত হয়েছে। গত সাত দিনে এ জেলায় মোট ১১ হাজার ৪৮৫ জন টিকা নিয়েছেন।
এই সময়ে টিকা নেওয়ার জন্য নিবন্ধন করেছেন ১৯ হাজার ৫৫২ জন। বর্তমানে প্রতিদিন জেলায় গড়ে দেড় হাজার মানুষ টিকা নিচ্ছেন আর নিবন্ধন করছেন দুই হাজারেরও বেশি। টিকা নিতে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে জেলার প্রত্যন্ত হাওরের ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রামসহ প্রায় প্রতিটি উপজেলায় লিফলেট বিতরণ ও জারিগান গেয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ ও সচেতন করা হচ্ছে। এ ছাড়া টিকাদান কেন্দ্রগুলোতে স্পট নিবন্ধনও চালু আছে। ফলে দিন দিনই নিবন্ধন ও টিকা গ্রহণের সংখ্যা বাড়ছে। জেলার সিভিল সার্জন ডা. মুজিবুর রহমান জানান, টিকা নিতে মানুষের আগ্রহ বেড়েই চলেছে। প্রথম ধাপের চালান দিয়ে ৪৫ হাজারের মতো মানুষকে টিকা দেওয়া যাবে। এই চালান শেষ হওয়ার আগেই দ্বিতীয় চালান চলে আসবে। চট্টগ্রামে শহরের তুলনায় বেশি ভিড় উপজেলায় : চট্টগ্রাম ব্যুরো, জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধিরা জানান, সেখানে নিবন্ধনকারীদের মধ্যে গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দাই বেশি। নিবন্ধনের বিপরীতে নগরীতে টিকা গ্রহণের হার ৩৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ। তবে উপজেলাগুলোতে এই হার ৯৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ। তবে নগরীর চেয়ে এখানকার উপজেলাগুলোতে নিবন্ধনকারীর সংখ্যা তুলনামূলক কম। শনিবার পর্যন্ত চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলায় ২৯ হাজার ১০৫ জন নিবন্ধন করে টিকা নিয়েছেন ২৭ হাজার ৪৬২ জন। বিপরীতে নগরীতে ৮১ হাজার ৫০০ জন নিবন্ধন করে টিকা নিয়েছেন ৩০ হাজার ৪৪০ জন। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন সমকালকে বলেন, প্রথম দিকে চাপ কম থাকলেও মানুষের মধ্যে টিকা নিয়ে সচেতনতা বাড়ছে। ফলে টিকাদান কেন্দ্রগুলোতে ভিড়ও বাড়ছে। প্রত্যেক উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দুটি বুথে টিকা দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে বুথের সংখ্যা বাড়ানো হবে। তবে এ পর্যন্ত তেমন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। টিকা নেওয়ার পর কারও কারও শরীরে সামান্য জ্বর-ব্যথা হচ্ছে। যে কোনো টিকায় এটা হয়ে থাকে। আর প্রথম দিকে টিকাদানে কিছুটা সমস্যা হলেও সেটা এখন কেটে গেছে। সীতাকুন্ড উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নুরুদ্দিন রাশেদ জানান, সেখানে রোববার পর্যন্ত এক সপ্তাহে টিকা নিতে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার লোক নিবন্ধন করেছেন। তার মধ্যে চার হাজার ৪৯ জন টিকা গ্রহণ করেছেন। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমকর্তা ডা. মিজানুর রহমান জানান, এ উপজেলায় প্রায় ২৩ হাজার ডোজ টিকা পাঠানো হয়েছে। গত রোববার পর্যন্ত নিবন্ধন করেছেন চার হাজার ২০০ জন। বিপরীতে টিকা নিয়েছেন ২৬৮৪ জন। প্রথম দিন এই উপজেলায় টিকা নিয়েছিলেন মাত্র ৫০ জন। কিন্তুএক দিনেই টিকা নিয়েছেন ৬৪০ জন।