প্রশান্তি ডেক্স ॥ যশোরের মণিরামপুরে এবার মোবাইল চোর সন্দেহে নির্যাতনে মামুন হাসান (২২) নামে এক মাদরাসা ছাত্রের করুণ মৃত্যু হয়েছে। গত বুধবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে মণিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মত্যু হয়। এর আগে গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১১টা থেকে তিনটা পর্যন্ত চারঘন্টা হাত-পা বেঁধে মারপিট করা হয় মামুনকে। পরে স্থানীয় একটি মসজিদের পাশে তাকে ফেলে রাখা হয়। গত বুধবার সকালে থানা থেকে পুলিশ নিয়ে মা ছকিনা বেগম মামুনকে উদ্ধার করে মণিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন।
মামুন হাসান উপজেলার খোজালিপুর গ্রামের মশিয়ার গাজীর ছেলে। তিনি মণিরামপুর আলিয়া মাদরাসার আলিম দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। স্থানীয় ইউপি মেম্বর আনিছুর রহমান পূর্বপশ্চিমকে বলেন, গত মঙ্গলবার রাতে চুরির উদ্দেশে একই গ্রামের আয়নালদের ঘরে উঠতে যায় মামুন ও আরমান নামে দুই যুবক। তখন তারা ধরে মামুনকে মারপিট করে। রাত তিনটার দিকে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে নিয়ে যায়। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি মামুনের হাত-পা বাঁধা। কয়েকজন নারী ও শিশুরা ছাড়া কাউকে পাইনি। আমি বাঁধন খুলে দিয়ে মামুনের বাড়িতে খবর দিই। প্রথমে কেউ আসেনি। আবারও তাদের খবর দেওয়া হয়। এভাবে সকাল হয়ে যায়। ততক্ষণে পুলিশ এসে পড়ে। মেম্বরের দাবি, মামুন নিজ গ্রামসহ আশপাশের গ্রামে একাধিকবার বৈদ্যুতিক সেচপাম্প (মোটর) ও মোবাইল ফোন চুরি করে। আটমাস আগে আয়নালদের একটি ফোন চুরি করে মামুন। তখন শালিসের মাধ্যমে মোবাইল ফেরত দেয় সে। তবে, মামুনের বিরুদ্ধে আর কোনো চুরির প্রমাণ দিতে পারেননি মেম্বর। গতরাতে নির্যাতনের সময় তার কাছে চোরাই কোনো মালামাল পাওয়া যায়নি বলে নিশ্চিত করেছেন মেম্বর।
এদিকে মামুনের সাথে থাকা আরমানকে গত মঙ্গলবার রাতে হালকা মারপিট করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আরমনের বাড়ি কদমবাড়িয়া গ্রামে। খোজালিপুর ও কদমবাড়িয়া দুই গ্রামের অবস্থান পাশাপাশি। মামুনের মা ছকিনা বেগম পূর্বপশ্চিমকে বলেন, রাত ১১টার দিকে ভাত খেয়ে বাড়ির পাশে খালা রেহেনা বেগমের দোকানে যায় আমার ছেলে। তখন আরমান নামে এক ছেলে মামুনকে ডেকে বাড়ির পাশে হরিহর নদীর পাড়ে নিয়ে যায়। আরমান সম্পর্কে মামুনের বন্ধু। তাদের দুইজনকে সেখানে দেখে দলপাকিয়ে লোকজন এসে মামুনকে নদীর পানিতে ফেলে মারপিট করে। সেখান থেকে তুলে আয়নালদের বাড়িতে নিয়ে তাকে পেটায়। আমি খবর পেয়ে যেয়ে দেখি আমার ছেলের মরণাপন্ন অবস্থা। তখন ওরা বলে আমার ছেলে মোবাইল চুরি করেছে। আমি চোরাই ফোন দেখতে চাইলে মেম্বর আমারে মারতে আসে। আমার ছেলেরে সিরাজ, মামুন, আলমগীর, আয়নাল, আকের, ইউনুস, মুরাদ, ইসরাইল, আকতারুল, মিন্টুসহ আরো অনেকে মেরেছে। ছকিনা বেগম আরো বলেন, রাত তিনটার দিকে যখন আমার ছেলে মারা যাচ্ছিলো তখন ওরা চুরির অপবাদ দিয়ে ওর চুল কেটে দেয়। সকালে আমি থানায় এসে পুলিশ নিয়ে যাই। পরে পুলিশের সাহায্যে ওরে মণিরামপুর হাসপাতালে ভর্তি করি। হাসপাতালের বেডে বিকেল তিনটার দিকে আমার ছেলে মারা যায়।
স্থানীয়রা বলছেন, পূর্বের মোবাইল চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে মামুনের ওপর ক্ষেপে ছিলেন আয়নালরা। সেই কারণে গত মঙ্গলবার রাতে তারা মামুনকে হাত-পা বেঁধে নির্যাতন করেন। কাশিমনগর ইউপি চেয়ারম্যান জিএম আহাদ আলী পূর্বপশ্চিমকে বলেন, রাতে আনিছুর মেম্বর আমাকে বিষয়টি জানায়। মোবাইল চুরি করতে গেলে মামুনকে জনগণ মারপিট করে বলে জেনেছি। মামুন কিছুটা উৎশৃঙ্খল প্রকৃতির ছিল। তবে, আমি কখনো ওর বিরুদ্ধে চুরির শালিস করিনি। মণিরামপুর হাসপাতালের চিকিৎসক উলফাত-আরা পূর্বপশ্চিমকে বলেন, গত বুধবার সকাল আটটা ২৫ মিনিটে মামুনকে হাসপাতালে আনা হয়। তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল। আমরা রোগীকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলি। কিন্তু স্বজনরা নেননি। পরে বিকেল তিনটার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মামুনের মৃত্যু হয়। মণিরামপুর থানার ওসি রফিকুল ইসলাম গত বুধবার সন্ধ্যায় ঘটনাস্থল থেকে পূর্বপশ্চিমকে বলেন, আমি ঘটনাস্থলে আছি। শুনেছি, মামুনকে মারপিট করা হয়েছে। ফলে তার মৃত্যু হয়েছে। যারা মেরেছে তারা চুরির বিষয়টি বলছে। ঘটনার সাথে জড়িত দুই জনকে আটক করা হয়েছে। অধিকতর তদন্ত চলছে। প্রসঙ্গত, সম্প্রতি মণিরামপুরে মোটরসাইকেল ছিনতাইকারি সন্দেহে বোরহান কবির নামে এক কলেজ ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।