ভাগ্যের নির্মম পরিহাস: বিয়েতে খরচ ৩০ লাখ, সমাধি হয় মাত্র ১০ রুপিতে!

প্রশান্তি ডেক্স ॥ উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি ছিলেন অযোধ্যার নবাব। ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দে তার বিয়েতে খরচ হয়েছিল ৩০ লাখ রুপি। তার মাত্র ২৩ বছর পরে বন্দিদশায় অবর্ণনীয় যন্ত্রণার পর মৃত্যু হয়েছিল নবাব ওয়াজির আলি খানের। তাকে সমাধিস্থ করতে ব্রিটিশ শাসক খরচ করেছিল ১০ রুপি। কলকাতার কাসিয়াবাগানে কোথায় হারিয়ে গিয়েছে সেই সমাধি। নবাবি ওয়াজিরের জন্ম ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দের ১৯ এপ্রিল। তিনি ছিলেন নবাব আসফউদদৌল্লাহর বোনের ছেলে। পরে তাকেই দত্তক নেন অপ্ত্রুক নবাব। মাত্র ১৪ বছর বয়সে ওয়াজিরের বিয়ের আয়োজন করেন তার পালক পিতা। কয়েক মাস ধরে লখনউয়ে চলে তার বিয়ের উৎসব।
তার ৩ বছর পরে মৃত্যু হল আসফউদদৌল্লাহর। ব্রিটিশদের সমর্থনে সিংহাসনে অভিষেক হল ওয়াজিরের। তিনি কিন্তু ব্রিটিশদের সুরে সুর মেলাতে পারলেন না। প্রথম থেকেই বিরোধ বাঁধতে শুরু করল। ব্রিটিশদের মোকাবিলা করার ক্ষমতা কিন্তু ছিল না ওয়াজিরের। তিনি পরিবর্তে ব্রিটিশদের অপদস্থ করতে শুরু করলেন।
ওয়াজিরের আচরণ ধুরন্ধর ব্রিটিশের কাছে স্পষ্ট হতে সময় নিল না। তারা সিংহাসন থেকে তাকে সরিয়ে বসালেন দ্বিতীয় সাদাত আলিকে। তিনি ছিলেন সম্পর্কে ওয়াজিরের আত্মীয় । সিংহাসনচ্যুত ওয়াজিরকে বার্ষিক ৩ লাখ রুপি ভাতায় বারাণসী নির্বাসনে পাঠানো হল। অসহায় ওয়াজিরকে সেই নির্বাসন দন্ড মেনে নিতে হল। লখনউ থেকে তিনি চলে গেলেন বারাণসী। সেখানে রেসিডেন্ট জর্জ চেরীর দরবারে তাকে তলব করা হল। এর পর তার নির্বাসন ঠিকানা কোথায় হবে, ঠিক হওয়ার কথা ছিল ওই দরবারেই। ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জানুয়ারি পদচ্যুত নবাব হাজির হলেন চেরীর দরবারে।
ঠিক তলব রক্ষা উদ্দেশ্য ছিল না ওয়াজিরের। তিনি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন অনুগত ফৌজদের। তারা আক্রমণ করল চেরী-কে। ওয়াজিরের ফৌজের আক্রমণে প্রাণ হারালেন চেরী। মৃত্যু হল ক্যাপ্টেন কনওয়ে এবং মিস্টার গ্রাহামেরও। এরপর ওয়াজির চললেন বারাণসীর তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট স্যামুয়েস ডেভিসের বাসভবনের দিকে। সেখানে বাড়ির সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ডেভিস সাহেব একা বর্শাহাতে ঠেকিয়ে রাখলেন তাদের আক্রমণ। তাকে রক্ষা করতে ব্রিটিশ বাহিনী চলে আসায় ঘটনাস্থল ছেড়ে পালান ওয়াজির ও তার সঙ্গীরা।
এই ঘটনা পরিচিত ‘বারাণসী তান্ডব’ নামে। বারাণসী ছেড়ে অনুচরসমেত ওয়াজির চলে গেলেন দাক্ষিণাত্যের বেরার প্রদেশে (বর্তমানে হায়দরাবাদ)। কিন্তু সেখানে গিয়ে শেষরক্ষা হল না। ব্রিটিশ ফৌজদের হাতে ধরা পড়লেন তিনি। বন্দি ওয়াজিরকে পাঠিয়ে দেওয়া হল তৎকালীন রাজধানী কলকাতায়।
ব্রিটিশদের বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন অতীতের নবাব। তার জীবনের বাকি দিনগুলো কেটেছিল ফোর্ট উইলিয়ামের এক নির্জন কুঠুরিতে। অনাহারে বন্দিদশা কেটেছিল অতীতের অযোধ্যার সিংহাসনের উত্তরাধিকারীর। তেষ্টায় কাতর হয়ে গেলেও বরাদ্দের বেশি একফোঁটা পানিও তাকে দেওয়া হত না।
১৮১৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মে কলকাতায় মৃত্যু হয়েছিল ওয়াজির আলি খানের। তখন তার বয়স মাত্র ৩৭ বছর। তার শেষকৃত্যের জন্য ফোর্ট উইলিয়াম থেকে বরাদ্দ করা হয়েছল মাত্র ৭০ রুপি। কবর দেওয়ার খরচ হিসেবে পড়েছিল সাকুল্যে ১০ রুপি। তখনকার নিরিখে যদিও সেই বরাদ্দ কম ছিল না ঠিকই। কিন্তু যখন মনে পড়ে ওই ঘটনার ২৩ বছর আগে ওয়াজিরের বিয়েতে ৩০ লাখ রুপি লখনউয়ের বাতাসে উড়েছিল, তখন তার ভাগ্যের পরিহাস সত্যি বেশি কটু মনে হয়।
৩৭ বছরের জীবনে নবাবের শেষ ১৭ বছর কেটেছিল কারাগারে। অযোধ্যার সিংহাসনে ছিলেন মাত্র ৪ মাস। ১৭৯৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৭৯৮ সালের ২১ জানুয়ারি। তারপরই সিংহাসনচ্যুত হন। রেখে গিয়েছিলেন ৪ সন্তানকে। তারা হলেন মির্জা জালালউদ্দিন হায়দর আলি জান বাহাদুর, নবাব মুবারক উদ-দৌলা, মির্জা মহম্মদ আলি খান এবং শাহিবজাদি সাদাতউন্নিসা বেগম। তাদের মধ্যে মুবারক উদ দৌলা পরবর্তীতে চলে গিয়েছিলেন অটোমান সাম্রাজ্যের দিকে। তবে তার সম্বন্ধেও খুব বেশি জানা যায়নি। বাকিরাও মিলিয়ে গিয়েছেন কালের স্রোতে।
ওয়াজির আলি খানের সমাধিও আজ হারিয়ে গিয়েছে। গোমতীপারের শহর থেকে শুরু হয়ে তার যাত্রা শেষ হয়ে গিয়েছিল গঙ্গার ধারে বাংলায়। কলকাতার মাটি নিজের কোলে টেনে নিয়েছে ৪ মাস নবাবের দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পাওয়া এই হতভাগ্য অকালমৃতকে। সূত্র: আনন্দবাজার

Leave a Reply

Your email address will not be published.