প্রশান্তি ডেক্স ॥ ছেলেটির নাম সবুর। বয়স ৮ কি ৯। কখনো কমলাপুর রেলস্টেশনে, কখনো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশের ফুটপাথে শুয়ে পার হয় রাত। আবার কখনো বন্ধুদের নিয়ে ট্রেনে চড়ে পাড়ি দেয় দেশের অন্য কোনো প্রান্তে। আবার ফিরে আসে ঢাকায়। মনে নেই বাবা-মায়ের কথা। নামটি কে দিয়েছে তাও জানে না। সভ্য সমাজের চোখে সবুর টোকাই। কখনো চোর, কুলি বা ভিক্ষুক। যে ঢাকা দেড় কোটির বেশি মানুষকে জায়গা দিয়েছে, সেই ঢাকার অলি-গলিতে অনাদর, অবহেলায় বেড়ে উঠছে এমন অসংখ্য সবুর। এসব শিশুর নেই কোনো শৈশব। নেই শিক্ষা। নেই বাবা-মায়ের আদর। গত ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর এয়ারপোর্ট রেলস্টেশনে দেখা হয় সবুরের সঙ্গে। এক একটা ট্রেন এলেই তিন বন্ধু যাত্রীদের কাছে দৌড়ে গিয়ে বলছিল, ‘স্যার, লাগেজ টাইন্যা দেই, যা মন চায় দিয়েন।’ টাকার জন্য নিজের দেহের ওজনের চেয়ে ভারী ব্যাগ ধরে টানাটানি করছিল সবুর, জুয়েল ও শফিকুল। লালমনি এক্সপ্রেস রেলস্টেশন ছাড়ার পর কথা হয় সবুরের সঙ্গে। জানায়, রাতে ট্রেনে চড়ে ঢাকার বাইরে যাবে। কোথায় যাবে তা এখনো ঠিক হয়নি। খাওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে বলল, ‘অহনো খাই নাই, তয় ট্রেনেই মিলল্যা যাইবো।’ এর পরই আবার দৌড়ে বন্ধুদের সঙ্গে যোগ দেয়। খানিক বাদে বন্ধুদের নিয়ে ফিরে এসে বলল, ‘ট্যাকা দ্যান, রুটি খামু’। রুটি-কলা কিনে দিয়ে কথা হয় তাদের সঙ্গে। বাবা-মায়ের কথা মনে নেই সবুরের। জুয়েল ও শফিকুলের বাবা নেই। মায়ের মুখটাও স্মৃতি থেকে ঝাপসা হয়ে গেছে। যেখানে রাত হয়, সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ে। খাটে বা তোষকে ঘুমাতে কেমন লাগে, সেই অভিজ্ঞতা নেই কারও।
পরদিন খিলগাঁও মডেল কলেজের গেটের পাশে রাখা স্যুয়ারেজ লাইনের বড় একটি পাইপের মধ্যে দেখা মেলে মামুন, শুকুর, হৃদয় ও শামীমের সঙ্গে। বয়সে সবাই শিশু। দুই মাস আগে ছিল ছয়জন। ‘বন্ধু আশির দশক’ নামের একটি সংগঠন টঙ্গীতে একটি মেটাল ফ্যাক্টরিতে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছে কাশেমের। হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে আকাশ। কখনো ওই পাইপের মধ্যে, কখনো অন্য কোনো গলিতে বন্ধ দোকানের সামনে ঘুমিয়ে পার করে রাত। এর মধ্যে একজনের বয়স ৭ বছর। নিয়মিত ডান্ডি (জুতায় লাগানোর আঠা) দিয়ে নেশা করে। মামুনের বাড়ি চট্টগ্রাম, শুক্কুরের সিলেট, শামীমের খুলনা। হৃদয় জানে না কোথায় তার বাড়ি। কেউই জানে না তাদের বাবা-মা কোথায়। শুক্কুর বলে, ‘ছোটবেলায় মা আমারে ঢাকায় রাইখা চইলা গেছে।’ মামুন মারের ভয়ে একদিন রাতে ঘর ছেড়ে ঢাকা চলে আসে। শামীম বলে, ‘ছোট বেলায় মায়ের লগে ঢাকায় আহি। আমি সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে হারাইয়া যাই।’ হৃদয় কিছুই বলতে পারে না মা-বাবা সম্পর্কে। প্রত্যেকের চেহারায় অপুষ্টি ও কষ্টের ছাপ। জানায়, চারজনই ভাঙ্গাড়ি কুড়ানোর কাজ করে। অনেক রাত না খেয়েই ঘুমাতে হয়। ডান্ডি দিয়ে নেশা করলে মশার কামড় ও ক্ষুধা টের পাওয়া যায় না। মাঝেমধ্যে কিছু মানুষ এসে খাবার কিনে দেয়। ছবি তোলে। এদিকে রাত ১১টার দিকে মিরপুর মাজার এলাকায় গিয়ে অনেক মেয়ে শিশুকেও রাস্তায় ঘুমিয়ে বা বসে থাকতে দেখা গেছে। তবে কথা বলা সম্ভব হয়নি তাদের সঙ্গে। এ ব্যাপারে অবহেলিত পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা নেদারল্যান্ডসের টেরে ডেস হোমসের কান্ট্রি ডিরেক্টর মাহমুদুল কবির বলেন, ১৩-১৪ বছরের অনেক মেয়ে শিশুকেও রাতে মিরপুর মাজারে ও আশপাশের সড়কে ঘুমাতে দেখবেন। এই মেয়েগুলো প্রতিনিয়ত ধর্ষিত হয়। অনেকে গণধর্ষণের শিকার হয়। এদের কারও বাবা ছেড়ে চলে গেছে। মা অন্যত্র বিয়ে করেছে। অনেক শিশুকে জন্মের পরপরই মা ডাস্টবিনে বা রাস্তায় ফেলে গেছে। অনেক ছেলে পথশিশুও বলাৎকারের শিকার হচ্ছে। আবার কোনো মেয়েশিশু একবার ধর্ষণের শিকার হলে পরিবার আর জায়গা দিচ্ছে না। বাকি জীবনটা তার এভাবে কাটছে। পথশিশুগুলোর না আছে বর্তমান, না আছে ভবিষ্যৎ। সব সময় এক ধরনের ট্রমার মধ্যে থাকে শিশুগুলো। এক সময় নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এদের জন্য সরকারিভাবে প্রকল্প নেওয়া দরকার। শুধু খাওয়া বা ঘুমানোর জায়গা দিলে হবে না, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা করে গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়া শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না, সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এরাও আমাদের সন্তানের মতোই।