প্রশান্তি ডেক্স ॥ জামালপুরের ৯ নম্বর রানাগাছা ইউনিয়নের জহুরুল হক ১০ বছরের বেশি সময় ধরে আছেন ঢাকায়। স্ত্রী সাবিহা খাতুনকে নিয়ে বসবাস করছেন খিলগাঁওয়ের ফুটপাথে ঝুপড়ি তুলে। প্রতিদিন ভোর হলেই শৌচকর্মের জন্য জহুরুল ছুটে যান এক বাসা থেকে আরেক বাসায়। অনুনয় করে দারোয়ানের মন গলানোর চেষ্টা করেন। গোসল ও খাবারের পানি জোগাড় করেনও একই উপায়ে। অনেক সময় সপ্তাহেও মেলে না গোসলের সুযোগ। স্ত্রী সাবিহা গৃহকর্মীর কাজ করেন কয়েকটি বাসায়। সেখানে গিয়েই সারেন গোসল ও প্রাকৃতিক কর্ম। রাতে প্রকৃতির ডাক আসলে পড়েন চরম বিপাকে।
তখন সবারই গন্তব্য হয় আশপাশের রেললাইন, ফুটপাথ বা খোলা স্যুয়ারেজ। রাজধানী ঢাকাকে একটি আধুনিক, পরিচ্ছন্ন ও মানবিক শহর হিসেবে গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন বর্তমান দুই মেয়র। সেই ‘মানবিক’ ঢাকায়ই ফুটপাথে এমন অমানবিক জীবন-যাপন করছেন অসংখ্য মানুষ। সেই সঙ্গে তাদের পয়ঃবর্জ্যে দূষিত হচ্ছে রাজধানীর পরিবেশ। শুধু জহুরুল হকের পরিবার নয়, রাজধানীর খিলগাঁও কমিউনিটি সেন্টারের পাশের ফুটপাথে এমন মানবেতর জীবন-যাপন করতে দেখা গেল ২৬টি পরিবারকে। ফুটপাথে ছাপরা তুলে ঘুমানোর জায়গা তৈরি করলেও নেই কোনো শৌচাগার। নেই গোসল বা খাবার পানির ব্যবস্থা। নেই বিদ্যুতের আলো বা রান্নার ব্যবস্থা। জহুরুল হক বলেন, গ্রামে জমিও নেই, কাজও নেই। তাই ঢাকায় এসেছিলাম। এসে দারোয়ানের চাকরি করতাম। কিছুদিন দিনমজুরের কাজ করেছি। কয়েকবার অপারেশন হওয়ায় এখন কাজ করতে পারি না। স্ত্রী মানুষের বাসায় কাজ করে যা পায়, তাই দিয়ে সংসার চলে। ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ফুটপাথে ঝুপড়ি তুলে এভাবে কষ্টে কাটাচ্ছি। এখানে যারা আছেন, তাদের সবার একই অবস্থা। মরলে কবর দেওয়ার জায়গাও নেই অনেকের। সরকার ভূমিহীনদের ঘর দিচ্ছে শুনে জলিল চেয়ারম্যানের (৯ নম্বর রানাগাছা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান) সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তিনি বলেছেন, ‘তোমাদের জন্য ঘর আসে নাই’। শুনেছি, চেয়ারম্যান যার কাছ থেকে পয়সা পাচ্ছে, তার নাম তালিকায় দিচ্ছে। সত্যি-মিথ্যা জানি না। এ ব্যাপারে ৯ নম্বর রানাগাছা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল জলিলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, টাকা নিয়ে ঘর দেওয়ার অভিযোগটি সত্য নয়। থানা নির্বাহী কর্মকর্তা নিজে তদারকি করছেন। তারপরও অনেক সময় মেম্বারদের কেউ কেউ ঘর দেওয়ার কথা বলে টাকা নিতে পারে। সবাই তো একরকম নয়। আমার এলাকায় ৫০টি ঘর এসেছিল। ৪৩টি ঘর দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আমার বিবেচনাতেই একজন ঘর পাওয়ার যোগ্য না। কীভাবে বরাদ্দ পেয়েছে জানি না। খাস জমির ব্যবস্থা করতে না পারায় সাতটি ঘর ফেরত গেছে। নতুন করে ৩০টি ঘরের জন্য চাহিদাপত্র দিয়েছি। জমি খুঁজছি। জহুরুল হকের বিষয়টা মনে করতে পারছি না। তবে তিনি ভূমিহীন হলেও আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে সর্বাত্মক সহযোগিতা করব।
এদিকে জহুরুল হক জানান, তাদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেতে হয় গোসল, খাবার পানি ও শৌচাগার নিয়ে। পাশে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন একটি গণশৌচাগার করলেও সেটা কখনো চালু হয়নি। দুই-তিন মগ পানি দিয়ে গোসল করেন। অনেক দিন গোসল হয় না। টয়লেটের কাজ সারতে বিভিন্ন বাসায় দৌড়াতে হয়। নারীরা বিভিন্ন বাসায় কাজ করে। সেখানেই গোসল ও টয়লেটের কাজ সেরে আসেন। বাচ্চারা ফুটপাথে প্রস্রাব-পায়খানা করে। মেয়েরা বেশি ঝামেলায় থাকে। অনেকে এজন্যই বাসাবাড়িতে কাজ নেয়। এখানকার প্রায় শতভাগ শিশু-কিশোর-কিশোরী বঞ্চিত শিক্ষার আলো থেকে। অন্যদিকে রাতের বেলায় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে নারী-পরুষ সবাই লোকলজ্জা ভুলে ছুটে যেতে হচ্ছে আশপাশের রেললাইনে বা ড্রেনের পাশে। রাজধানীর ভোটার না হওয়ায় সরকারের ত্রাণ বা সহযোগিতাও পান না। গতকাল সরেজমিন রাজধানীর খিলগাঁও ছাড়াও হাই কোর্ট গেট, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের আশপাশ, কারওয়ান বাজার, পলাশী মোড়ে এমন অনেক ছিন্নমূল মানুষ ও পরিবারের দেখা মিলেছে। তাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে এসেছে এমন অমানবিক জীবনের চিত্র। এদিকে রাজধানীতে কত সংখ্যক ছিন্নমূল মানুষ আছে তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি কারও কাছে। দুই সিটি করপোরেশন বলছে, ২০১৪ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরো একটি শুমারি করেছে। ওই শুমারি অনুসারে দুই সিটিতে তখন ছিন্নমূল মানুষ ছিল তিন লাখের কাছাকাছি। ঢাকায় ছিন্নমূল মানুষদের নিয়ে সাজেদা ফাউন্ডেশনের ‘আমরাও মানুষ’ নামে একটি প্রকল্প কাজ করে। ওই প্রকল্পের সমন্বয়কারী এম ফারুক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ছিন্নমূলদের নিয়ে সাম্প্রতিক কোনো জরিপ নেই। তবে আগে ফুটপাথে এমন ঝুপড়িঘর অনেক ছিল। মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন উন্নয়নের জন্য ভেঙে দেওয়ায় কেউ বস্তিতে, কেউ গ্রামে চলে গেছে। মধ্যম আয়ের দেশ ঘোষণার পরে দ্রুত সংখ্যাটা কমেছে। বর্তমানে এমন পরিবার তিন-চারশ থাকতে পারে। আর খোলা আকাশের নিচে ছিন্নমূল মানুষ সব মিলে আছে ১০-১২ হাজার। ২০২০ সালের শেষে ঢাকার ১৩-১৪টি ওয়ার্ডে জরিপ করে আমরা ৬ হাজারের মতো ছিন্নমূল মানুষ পেয়েছি, যা আগে ২৫ হাজারের বেশি ছিল। এই মানুষগুলো সত্যিই অমানবিক জীবন-যাপন করছে। শৌচাগার না থাকায় তাদের পয়ঃবর্জ্যে পরিবেশ দূষণও ঘটছে।