রফিকুল ইসলাম ॥ কত কিছুই তো দখল হয়। বাড়ি, গাড়ি, খেয়াঘাট থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল পর্যন্ত। তাই বলে জরুরি মুহূর্তে জীবনরক্ষাকারী নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র (আইসিইউ)? তাও দখলের খবর শোনা যাচ্ছে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রোগীর স্বজন বলেন, ‘আইসিইউ শয্যাগুলো দখল করা হয়েছে। যাঁরা আছেন, তাঁদের আদৌ আইসিইউ প্রয়োজন কি?’ আইসিইউবঞ্চিতদের দাবি, যদি রোগীর অবস্থা মুমূর্ষ হতো, তাহলে ৭২ ঘণ্টায় আইসিইউ শয্যায় কোনো না কোনো রোগী মারা যেতেন। কিন্তু শেবাচিম হাসপাতালের পরিসংখ্যান বলছে, ৭২ ঘণ্টায় আইসিইউ শয্যায় চিকিৎসাধীন কোনো রোগীর মৃত্যু হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেবাচিম হাসপাতালের শীর্ষ পর্যায়ে কর্মকর্তারা জানান, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের (ভিআইপি) রোগী ভর্তি হলে, তাঁদের প্রয়োজন না হলেও আইসিইউ দিতে হয়। শুধু তাই না, জরুরি মুহূর্তে আইসিইউ নিলেও একসময় এই রোগীদের তা আর দরকার পড়ে না, তারপরও তাঁরা অনেকটা জোর করে শয্যা দখল করে রাখেন। গড়ে প্রতিদিন দুটি শয্যা ভিআইপিদের দখলে থাকে। গত মঙ্গলবার চারটি শয্যা বিনা প্রয়োজনে ভিআইপিদের দখলে ছিল। এই ভিআইপিদের মধ্যে রয়েছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং সরকারি দলের নেতারা। ফলে এ নিয়ে চিকিৎসকদের মধ্যে ক্ষোভ থাকলেও শেবাচিম কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না।
এ বিষয়ে শেবাচিম হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘প্রতিদিন গড়ে অন্তত ১০-১২ জন নতুন রোগীর আইসিইউ প্রয়োজন। কিন্তু ১২টি শয্যাই রোগীতে ভরা থাকায় কাউকে তা দেওয়া যাচ্ছে না। তা ছাড়া যাঁদের আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন নেই তাঁরাও শয্যা ছাড়ছেন না। ফলে শয্যা সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আইসিইউয়ে থাকা রোগীদের মধ্যে প্রতিদিন গড়ে অন্তত চারজন শয্যা ছেড়ে সিলিন্ডারের মাধ্যমে অক্সিজেনের সাহায্যে বেঁচে থাকতে পারেন। রোগীদের স্বজনরা প্রভাব বিস্তার করে আইসিইউ শয্যা ছাড়ছেন না। তাই সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে শয্যা বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শয্যা বাড়ানো হলে আইসোলেশন ওয়ার্ডে মৃত্যুর হার কমে আসবে।’
হাসপাতাল ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শেবাচিম আইসোলেশন ওয়ার্ডে গত ২৪ ঘণ্টায় ছয়জন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া এই ছয়জনের শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য আরটি পিসিআর ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। ফল পেতে স্বজনদের অন্তত আরো ১২ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। এর আগের ৪৮ ঘণ্টায় আইসোলেশন ওয়ার্ডে মারা যাওয়া ছয়জন করোনায় আক্রান্ত ছিল বলে ফল এসেছে। এ ছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা ওয়ার্ডে কেউ ভর্তি হয়নি। তবে করোনা ও আইসোলেশন ওয়ার্ডে ১৪৬ জন রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। একই সময়ে এ দুটি ওয়ার্ড থেকে ২৪ জনকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। ৪৮ ঘণ্টায় যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের আইসিইউ প্রয়োজন ছিল, কিন্তু তাঁরা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন কি? সেই তথ্য না থাকায় করোনা ওয়ার্ডের আইসিইউ শয্যায় নেওয়া হয়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চিঠি করোনার প্রকোপ দেখা দিলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ হাসপাতালের পূর্ব দিকের নতুন পাঁচতলা ভবনটিতে অনেকটা তড়িঘড়ি করে করোনা ইউনিট চালু করা হয়। প্রথম দিকে ২০ শয্যা দিয়ে যাত্রা হলেও ধীরে ধীরে ১৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। কিন্তু করোনা ও আইসোলেশন ওয়ার্ড মিলিয়ে সেখানে ১৫০-এর অধিক রোগী গড়ে প্রতিদিন থাকছে।
করোনায় আক্রান্ত কিংবা উপসর্গ দেখা দেওয়া রোগীদের আস্থার স্থল হিসেবে গড়ে ওঠায় এ হাসপাতালটিতে রোগীর চাপও দিন দিন বাড়ছে। এ অবস্থায় হাসপাতালটিতে সব থেকে বেশি প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে অক্সিজেন ও আইসিইউ সেবার। কেন্দ্রের পাশাপাশি সিলিন্ডারের মাধ্যমে রোগীদের জন্য অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে।
পাশাপাশি করোনা ওয়ার্ডে ১২টি আইসিইউ বেড দিয়ে যথাযথ সেবা দিতে হিমশিম খেতে হয় চিকিৎসকদের। সেইসঙ্গে প্রয়োজনীয় জনবলেরও সংকট থাকায় ভোগান্তির প্রভাবটা রোগীদের ওপর গিয়েই পড়ছে। তবে এসব অবস্থা থেকে উত্তরণের চেষ্টা চালাচ্ছে হাসপাতাল প্রশাসন। হাসপাতালের পরিচালক ডা. সাইফুল ইসলাম জানান, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আইসিইউ শয্যা ও সাধারণ শয্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। ৫০টি সাধারণ শয্যার পাশাপাশি ১০টি আইসিইউ বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে ১০টি আইসিইউ শয্যা পাঠানোর জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে।