প্রবাসফেরত হয়ে বেকার; একাকী কষ্ট, নিভৃত কান্না

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি ॥ সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার আর্থিক ক্ষমতা নেই বাবার। কারো কাছে বলতেও পারছেন না একসময়ে বেশ সক্ষম বাবা। কষ্ট সইতে না পেরে এখন দূরে সরে আছেন। সেই ‘লজ্জা’ থেকে তিনি ডুকরে কাঁদেন। বলতে গিয়েও কাঁদলেন। মা-ও কাঁদেন। অনাহারে থাকা সন্তানদের দেখে কাঁদেন। বাধ্য হয়ে এক সন্তানকে রেখেছেন বাবার বাড়ি। খাবারের সময় হলে আরেকজনকে পাঠিয়ে দেন বোনের বাড়ি। একমাত্র মেয়েটা সব সময়ই সঙ্গে থাকে। তবে রোজার এক সপ্তাহেও সন্তানের মুখে ইফতার তুলে দিতে পারেননি। সামান্য কিছু একটা মুখে দিয়ে তিনি রোজা রাখছেন নিয়মিত।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার এ পরিবারটি মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলতে পারছে না। লুকিয়ে প্রশাসনের কাছে সহযোগিতা চাইলে বাড়িতে কিছু ‘অনুদান’ পাঠানো হয়। এ প্রতিবেদক তাদের পরিবারের বর্তমান অবস্থা নিয়ে রিপোর্ট করতে চাইলে পরিচয় না দেওয়ারও আহ্বান জানান। পরিবারটির সদস্য সংখ্যা পাঁচ। স্বামী-স্ত্রী, দুই ছেলে এক মেয়ের সংসার। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ‘চাকরি’ করতেন একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে। সুযোগ আসা মাত্রই ঋণ করে ছুটে যান প্রবাসে। ভাগ্য বদলানোর বদলে নেমে আসে অন্ধকার। সারা বিশ্বের মতো করোনা পরিস্থিতির কারণে সৌদি আরবেও কাজ না থাকায় বিপাকে পড়ে যান। প্রায় ১১ মাস থেকে দেশে ফিরে আসেন এ বছরের ১১ ফেব্রুয়ায়ি। দেশে এসেও কোনো কাজের ব্যবস্থা করতে না পেরে পরিবারটির এখন দিন কাটে খেয়ে না-খেয়ে।
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বামীর বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার কাছাইট এলাকায়। স্ত্রীর বাড়ি আখাউড়া উপজেলার আজমপুরে। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে তাঁদের বিয়ে হয়। বর্তমানে আখাউড়া পৌর এলাকার কলেজপাড়ায় ভাড়া বাসায় থাকেন। বাড়ির কর্তা বলেন, ‘আমার জীবনে এই প্রথম এমন হলো যে সন্তানদের ইফতার কিনে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারিনি। স্ত্রী-সন্তানরা না খেয়ে আছে। তাদের কষ্ট সহ্য করতে পারি না। যে কারণে কিছু একটা করতে বাড়ি থেকে ঢাকায় চলে এসেছি। কিন্তু এখানে এসেও কোনো কাজ পাচ্ছি না। এখন লকডাউনের কারণে কোথাও কোনো কাজ নেই’।
তিনি বলেন, ‘আমার ভাইয়ের বাসায় আছি এখন। ওনারও চাকরি নেই। চার সন্তান নিয়ে সংসারের খরচ চালাতে ভাইকে হিমশিম খেতে হয়। এর মধ্যে আমি আছি এখানে। আমার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করলেও পরিবারের সদস্যদের জন্য কিছু করা তো তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না’। তিনি আরো বলেন, ‘চাকরি করেছি। ঋণ করে বিদেশে গেছি। সবাই তো মনে করে ভালো আছি। কিন্তু আমি আর আমার স্ত্রী জানি আমাদের সংসার কেমন চলেছে। তবে এতদিন খেয়ে বেঁচে ছিলাম। কিন্তু এখন ঋণ দেওয়া তো দূরের কথা খাওয়ার টাকাও নেই। কিভাবে কি করব বুঝতে পারছি না। সৌদি আরবের যার এখানে গিয়েছিলাম তিনি বলেছেন টিকিট কেটে চলে এলে কোথাও না কোথাও কাজের ব্যবস্থা করে দেবেন। কিন্তু টিকিট কাটার ৮০ হাজার টাকাই বা পাব কোথায়?’
ওই ব্যক্তির স্ত্রী বলেন, ‘আমার স্বামী বিদেশে যাওয়া মাত্রই লকডাউনে কবলে পড়েন। আমার ও তাঁর আত্মীয়-স্বজনের সহযোগিতায় কয়েক মাস সেখানে থাকলেও কাজ ছিল না। এ অবস্থায় সেখানকার মালিক ছুটি দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দেন। বিদেশে গিয়ে এক টাকাও আয় করতে না পারায় প্রায় তিন লাখ টাকার মতো ঋণ আর শোধ দেওয়া হয়ে ওঠেনি’। তিনি বলেন, ‘কাজের আশায় আমার স্বামী ঢাকায় গেছেন। লকডাউনের কারণে সেখানেও কাজ নেই। তিনি আসতেও পারছেন না। এদিকে আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে কাউকে কিছু বলতেও পারছি না। আমি একদিন চুপচাপ ইউএনও অফিসে গিয়ে আমার কষ্টের কথা বলে আসি। তারাও অনেকটা গোপনে আমাকে সহযোগিতা করেন’। তিনি বলেন, ‘দিন যাচ্ছে আর অবস্থা খারাপ হচ্ছে। খেয়ে না-খেয়ে রোজা রাখতে হচ্ছে। সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে পারছি না। বাধ্য হয়ে একজনকে বাবার বাড়ি, আরেকজনকে বোনে বাড়িতে পাঠাই খাবারের জন্য’।
ওই নারীর এ প্রতিবেদকের কাছে এমন অবস্থা থেকে উত্তরণে সহযোগিতা কামনা করেন। তবে এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করলেও যেন নাম-ঠিকানা না দেওয়া হয় সে অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের যে পারিবারিক অবস্থান তাতে কারো কাছে হাত পাততেও লজ্জা লাগে’। এদিকে প্রবাসীর ওই পরিবারের কথা চিন্তা করে এ প্রতিবেদকের মাধ্যমে জানতে পেরে দুই সন্তানের জন্য পোশাকের ব্যবস্থা করেছে ‘হাসিমুখ’ নামে স্থানীয় একটি সংগঠন। শিশুদের জন্য জুতা কিনে দেওয়ার চেষ্টাও চলছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.