স্বপন চৌধুরী, রংপুর প্রতিনিদি ॥ রংপুর শহরে গিজগিজ করছে মানুষ। প্রধান সড়ক ছাড়াও অলিগালতেও ঢোকা দায় হয়ে পড়েছে যানজটের কারণে। ভিড় সামলাতে অনেকটাই নাজেহাল হতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মীদের। করোনা রোধে চলমান লকডাউনেও দোকানপাট ও শপিংমল খোলা থাকায় ঈদকে ঘিরে শহরে মানুষের ভিড় বেড়েছে। তার ওপর করোনাকালে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে বিভাগীয় নগরী রংপুরে ঢুকছে কর্মহীন হয়ে পড়া নানা পেশার মানুষ।
করোনার কারণে দেশের অর্থনীতির চাকা হোঁচট খেয়েছে। ভারী হয়েছে লোকসানের বোঝা। কেউ কেউ প্রতিযোগিতার বাজারে টিকতে না পেরে হয়েছে নিঃস্ব। অসংখ্য মানুষ হারিয়েছে রুটি রোজগারের পথ। চাকরি হারিয়ে গ্রামে ফিরেছেন লাখো মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে অনেকেই। কেউবা আবার কোনো উপায় না পেয়ে পথে-ঘাটে ঘুরে ঘুরে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন একটু সাহায্যের আশায়। এটা কারো জন্য ভিক্ষাবৃত্তি, আর কারো কারো বাঁচার লড়াই। সেই লড়াইয়ে এখন অসংখ্য ভিক্ষুকের ভিড় বেড়েছে বিভাগীয় নগরী রংপুরে। অলিগলি সবখানেই দেখা মিলছে নতুন নতুন মুখ। যাদের বেশিরভাগই মৌসুমি ভিক্ষুক।
গতা বৃহস্পতিবার দুপুরে রংপুর নগরীর বিভিন্ন অলিগলির মোড়ে, কাঁচাবাজর, ওষুধের দোকান, চায়ের দোকান, বিপণীবিতান, যানজটের সড়ক, হাসপাতাল, কেরামতিয়া মসজিদ চত্বর, কাচারিবাজার, আদালত চত্বর, বাস ও ট্রাক টার্মিনালসহ বিভিন্ন মার্কেটের সামনে দেখতে পাওয়া যায় অসংখ্য মৌসুমি ভিক্ষুক। এদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী। আবার অনেকে ঘুরছে দলবদ্ধ হয়ে। লক্ষ্য একটাই-জীবন বাঁচাতে সাহায্য পাওয়া। জাহাজ কম্পানি মোড়ে চিকিৎসার প্রেসক্রিপশন হাতে দাঁড়িয়ে সালেহা বেগম। মাস্ক না থাকলেও মুখে শাড়ির আঁচল। সামন দিয়ে কেউ যেতে না যেতেই হাত বাড়িয়ে চাইছেন সাহায্য। কথা হলে তিনি জানান, তার স্বামী ভ্যানচালক। আর তিনি অন্যের বাসাবাড়িতে কাজ করেন। কিন্তু করোনার কারণে তার কাজ বন্ধ করে দিয়েছে বাসার মালিক। চলমান লকডাউনে স্বামীর আয়ও অর্ধেকে নেমেছে। তারওপর তিনি হঠাৎ অসুস্থ হওয়াতে সংসার চলছে না। চিকিৎসার টাকাও জোগাড় করতে পারছেন না। তাই মানুষের দ্বারে দ্বারে সাহায্য চাইছেন।
সালেহার মতো আরেক নারীর দেখা মিলল কেরামতিয়া জামে মসজিদ মাঠে। সেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পযন্ত অনেক ভিক্ষুককেই দেখা যায়। রাবেয়া বেগম নামে ওই নারী ভিক্ষুক জানালেন তার অসহায়ত্বের কথা। আগে তিনি গঙ্গাচড়ায় বিভিন্ন গ্রামে ভিক্ষা করতেন। করোনার কারণে এখন সবারই অর্থ সংকট, মানুষ তেমন ভিক্ষা দেয় না। তাই শহরে এসেছেন। সারাদিনে ভিক্ষা করে যা জোটে তাই নিয়ে সন্ধ্যায় ১৩ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরে যান।
নগরীর পায়রা চত্বর, সেন্ট্রাল রোড, কামারপাড়া ঢাকা কোচ স্ট্যান্ড, সিটি বাজারসহ বেশ কয়েকটি স্পটে বিভিন্ন বয়সী এমন ৩০ জন নারী ও পুরুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, এদের কেউ গৃহশ্রমিক, কেউ হোটেলে রাঁধুনীর কাজ করেছেন। কেউ কেউ ঢাকার ফুটপাতে চা বিক্রি করতেন। করোনায় লকডাউনে কাজ হারিয়ে অসহায়ত্বের বোঝা মাথায় নিয়ে পথে নেমেছেন তারা। অন্যের কাছে দান বা ভিক্ষার জন্য হাত বাড়িয়ে দেওয়া এসব মানুষ পেটের জ্বালায় ভিক্ষাবৃত্তি করছেন। নাম না প্রকাশের শর্তে সেন্ট্রাল রোড এলাকায় পঞ্চাশোর্ধ এক ভিক্ষুক শোনান তার দুঃখের কথা। কিছুটা হতাশাচ্ছন্ন মুখে ওই ব্যক্তি জানান, তিনি ঢাকায় দোকানে কাজ করতেন। করোনার সময়ে কাজ হারিয়ে গ্রামে ফিরে আসেন। চাকরি হারিয়ে অনেক জায়গায় কাজের সন্ধান করেছেন।
কিন্তু কাজ না পাওয়ায় প্রতিদিন রংপুর শহরে এসে লোক বুঝে হাত বাড়িয়ে দেন বিভিন্ন অযুহাত নিয়ে। অন্যের অনুভুতিতে নাড়া দিয়ে চেয়ে বসেন সাহায্য। এভাবেই একমাস ধরে চলছেন তিনি। তবে একই এলাকায় একদিনের বেশি যান না বলেও জানান ওই ব্যক্তি। কেনাকাটাসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে শহরে আসা কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শতে বলেন, ‘এমনটি আগে কখনো দেখা যায়নি। যেখানেই দাঁড়াবেন, ঘিরে ধরছেন চার থেকে পাঁচজন।’ ঈদকে ঘিরে বিভিন্ন এলাকা থেকে করোনায় কর্মহীন লোকজন সাহায্যের আশায় এসেছেন বিভাগীয় নগরী রংপুরে। তাদের দলবদ্ধ চলাফেরার কারণেই এবারে যানজট বেশি হচ্ছে বলেও জানান তারা।