ভাসানচর থেকে পালাচ্ছেন রোহিঙ্গারা!

সায়ীদ আলমগীর ॥ কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ঘিঞ্জি ক্যাম্প থেকে নোয়াখালীর ভাসানচরে সুরম্য দালানের বসবাসের সুযোগ পাওয়া রোহিঙ্গারা এবার সেখান থেকেও পালাচ্ছে। ইতোমধ্যে ৪০-৫০ জন রোহিঙ্গা ভাসানচর দ্বীপের ইটের দেয়ালের ঘর ছেড়ে পালিয়েছেন বলে জানিয়েছেন শরণার্থী নেতারা। অনেকে স্ব-পরিবারে আবার কেউ কেউ পরিবারের অন্য সদস্যদের রেখেই ভাসানচর থেকে পালিয়েছেন। তবে পালিয়ে যাওয়াদের মাঝে ইতোমধ্যে ডজনাধিক রোহিঙ্গা ধরাও পড়েছেন। ঘিঞ্জি বাসের কথা বলে উখিয়া-টেকনাফের ক্যাম্প থেকেও নানাভাবে পালানোর চেষ্টা চালান রোহিঙ্গারা।
ভাসানচর হতে রোহিঙ্গাদের পলায়নকে ‘সুখে থাকতে ভুতে কেলায়’ প্রবাদের সাথে তুলনা করে রোহিঙ্গারা আসলেই অস্থির জনগোষ্ঠী বলে মন্তব্য করেছেন লোকাল এনজিওগুলোর সমন্বিত প্লাটফর্ম সিসিএনএফ’র ফোকাল আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা। তবে, ফিরে আসা কোন রোহিঙ্গার সাথে কথা বলা সম্ভব না হওয়ায় তারা কেন পালিয়ে আসছে সে তথ্য এখনো অজানাই রয়েছে।
সূত্র মতে, ভাসানচর থেকে পালাতে শুরু করেছে কিছু রোহিঙ্গা। ১৮ মে (মঙ্গলবার) সকালে ১১ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে সন্দ্বীপ থানা পুলিশ। এছাড়া টেকনাফের উনছিপ্রাং রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও নরুল আমিন নামের একজন রোহিঙ্গা যুবক ভাসান চর থেকে পালিয়ে এসেছে বলে নিশ্চিত করেছেন কক্সবাজার ১৬ এপিবিএন অধিনায়ক (এসপি)।
সূত্র জানায়, ভাসানচর থেকে পালিয়ে আসা ১১ রোহিঙ্গাকে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার রহমতপুর ইউনিয়ন থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ১৮ মে সকালে নোয়াখালীর ভাসানচর থেকে পালিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফ রওয়ানা দেয়ার চেষ্টাকালে তাদের গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ সূত্রে জানিয়েছে, গ্রেফতার ১১ রোহিঙ্গার মধ্যে ছয়জন নারী, তিনজন শিশু ও দুইজন যুবক রয়েছেন। গত মঙ্গলবার সকালে রহমতপুর এলাকায় স্থানীয় লোকজন তাদের দেখতে পেয়ে পুলিশকে খবর দেয়। পরে পুলিশ গিয়ে তাদের আটক করে।
আটক রোহিঙ্গাদের আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করে ভাসানচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহে আলম জানান, কিছু দিন আগেও ভাসানচর থেকে পালানোর চেষ্টায় আটজন রোহিঙ্গাকে আটক করে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভাসানচর থেকে দালালের মাধ্যমে জেলেদের ছোট নৌকায় সন্দ্বীপে আসছেন রোহিঙ্গারা। সেখান থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজারের টেকনাফসহ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছেন তারা।
এদিকে কক্সবাজার ১৬ এপিবিএন অধিনায়ক (এসপি) তারিকুল ইসলাম তারিক জানান, নুরুল আমিন (২০) নামে এক রোহিঙ্গা ১৭ মে রাতে ভাসানচর থেকে অজ্ঞাত দালালদের মাধ্যমে পালিয়ে উনচিপ্রাং ক্যাম্পে তার বাবার কাছে চলে আসে। এ তথ্যের ভিত্তিতে ক্যাম্প সিআইসি পালিয়ে আসা নুরুল আমিনকে ডেকে পাঠালে তাকে না পেয়ে তার বাবাকে সিআইসি অফিসে আনা হয়।
তার বাবাকে জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, ছেলে নুরুল আমিন প্রশাসনের ভয়ে বর্তমানে ক্যাম্পের বাইরে অবস্থান করছে। ভাসানচর থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরনার্থী নুরুল আমিনের বাবাকে তার ছেলেসহ বুধবার সিআইসি অফিসে হাজির হতে বলা হয়েছে।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা যুবক নরুল আমিন (২০) টেকনাফের উনছিপ্রাং ব্লক বি-৬, ঘর নং-২৮৫ এ বসবাসকারী (এফসিএন নং-২৪৩৯১০) জকির আহমেদের ছেলে। কিন্তু পরবর্তীতে তাকে সিআইসি অফিসে হাজির করা সম্ভব হয়েছে কিনা জানতে চাইলেও, সে ব্যাপারে কিছুই জানাননি এসপি তারিক।
গত ডিসেম্বরে রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে স্থানান্তর শুরু হওয়ার পর এপ্রিল পর্যন্ত কয়েক দফায় প্রায় ১৯ হাজার রোহিঙ্গা সেখানে পৌঁছান। সরকারি কর্মকর্তাদের মতে, সব রোহিঙ্গাই সেখানে স্বেচ্ছায় গেছেন। কিন্তু গত কয়েক মাসে সেখান থেকে ৪০-৫০ জন রোহিঙ্গা পালিয়ে গেছেন বলে জানিয়েছেন ভাসানচরের আশ্রয়ণ প্রকল্পের গুচ্ছগ্রামের থাকা একাধিক রোহিঙ্গারা।
তবে সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা, নৌবাহিনী এবং কোস্ট গার্ডের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে ভাসানচরে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) প্রতিনিধি ও ক্যাম্প ইনচার্জ (সিআইসি) রঞ্জন চন্দ্র দে বলেন, ১২-১৩ জন পলাতক রোহিঙ্গার একটি তালিকা আমরা পেয়েছি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি গুচ্ছগ্রামের রোহিঙ্গা নেতা সাংবাদিকদের বলেন, এখান থেকে ৪০-৫০ জন রোহিঙ্গা পালিয়েছেন। সর্বশেষ গত বুধবার বিকালে বেড়িবাঁধ থেকে পালানোর চেষ্টা করা চার রোহিঙ্গাকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
গুচ্ছগ্রামের আরেক নেতার মতে, এখানে আসার পর হতে প্রায় অর্ধশত রোহিঙ্গা ভাসানচর থেকে পালিয়ে গেছেন। আরও অনেকে পালানোর চেষ্টাকালে ধরা পড়েছেন। তাদের অনেককে কারাগারেও যেতে হয়েছে। তবু পালানোর চেষ্টা থামছে না। তবে পলাতক একজন রোহিঙ্গা ফিরে আসার ঘটনা ঘটেছে। সুরম্য দালানে সবধরনের সুযোগ পেয়ে বাস করলেও কঠোর নিরাপত্তার কারণে একে বন্দী জীবন বলে অবহিত করে অনেকে আগের ক্যাম্পে ফিরতে চাচ্ছে বলে অভিমত ভাসানচরে বসবাসকারীদের।
এদিকে, গত শনিবার চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের মাইটভাঙ্গা ইউনিয়নের চৌধুরী বাজার থেকে আটক হয় ভাসানচরের তিন রোহিঙ্গা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা পুলিশকে জানিয়েছেন, সাগরে তিনঘণ্টা সাঁতার কেটে সন্দ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছানোর পর বাংলাদেশি জেলেরা তাদের নৌযানে তুলে সেখানে নিয়ে গেছে।
সন্দ্বীপ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বশির আহমেদ খান সাংবাদিকদের বলেন, জেলেরা সাগরে সাঁতরাতে দেখে কয়কজনকে উদ্ধার করেন। পরে জানতে পারেন তারা রোহিঙ্গা, ভাসানচর থেকে পালিয়ে এসেছেন। এরপর তাদের ট্রলারে তুলে নিয়ে এসে মাইটভাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদে সোপর্দ করেন জেলেরা। আটক তিন জনের নাম নাজিম উদ্দিন, মোহাম্মদ নাসিম ও আবদুল হামিদ। তারা ভাসানচরের ৪৯ ও ৬২ নম্বর ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসার কথা বলেছেন। উখিয়ার ঘিঞ্জি ক্যাম্প হতে তারা স্বেচ্ছায়ই ভাসানচরে গিয়েছিলেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে বিদেশি নাগরিক সম্পর্কিত আইনে মামলা দিয়ে গত রবিবার আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
এ বিষয়ে ভাসানচর থানার ওসি মাহে আলম বলেন, ভাসানচর থেকে রোহিঙ্গারা প্রায়ই পালানোর চেষ্টা করে। তবে এমন অনেক চেষ্টাই ব্যর্থ করে দিয়েছি আমরা। কারাগারে পাঠানো রোহিঙ্গাদের জামিনে মুক্ত করে পুনরায় ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হতে পারে।
উখিয়া কুতুপালংয় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, স্বেচ্ছায় পরিবার নিয়ে ভাসানচরে যাওয়া অনেকে পরিবার রেখে পালিয়ে এখানে ফিরে এসেছে। প্রথমে সাঁতরে, পরে জেলেদের নৌকায় সাগর পাড়ি দিচ্ছে বলে উল্লেখ করছে ফিরে আসা ব্যক্তিরা। রোহিঙ্গাদের ভাসানচর ছেড়ে পালানোর বিষয়টি অবগত থাকার কথা জানিয়ে কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, পলাতকরা ভাসানচর থেকে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পথে আটক হওয়া রোহিঙ্গা। সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে আমরা এটা ঠেকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি।
এদিকে, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সাবেক কর্মকর্তা অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক বিশ্লেষক আসিফ মুনীর মনে করেন, ভাসারচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর শুরুর সরকারি সিদ্ধান্তে দূরদর্শিতার অভাব ছিল বলেই এমনটা ঘটছে। সরকার নিজে দায়িত্ব কাঁধে নিয়েই কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গাদের সেখানে স্থানান্তর করেছে। এখন সেখান থেকে কেউ পালিয়ে গেলে তার দায়টাও সরকারের ওপরই বর্তাবে। এক্ষেত্রে সরকার হয়তো বলবে, যে পরিমাণ নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেই তুলনায় পালিয়ে যাওয়ার হার খুবই কম, বেশিরভাগই ভাসানচরে ভালো আছে। কিন্তু একজন মানুষও যদি পালিয়ে থাকে সেটার কারণ খতিয়ে দেখা উচিত বলে উল্লেখ করেন তিনি।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা পালস্ এর প্রধান নির্বাহী, সিসিএনএফ’র ফোকাল ও কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, রোহিঙ্গারা এমন একটি জনগোষ্ঠী, তাদের যেখানেই রাখা হোক না কেন তারা পালানোর বা নানা অপরাধে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করবে। পৃথিবীতে জোরপূর্বক উদ্বাস্তু হওয়ারা অন্য কোথাও স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্ত হতে পারেনি। তাছাড়া ভাসানচরের চারদিকে সমুদ্রের যে বিশাল জলরাশি, এটা রোহিঙ্গাদের জন্য সমস্যা না। রাখাইন থেকে বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত মহাসাগর দিয়ে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে যাওয়ার চেষ্টা তারা যুগ যুগ ধরেই করে আসছে। নাফ নদী সাঁতরে টেকনাফে চলে আসার নজিরও আমরা দেখেছি। তাই ভাসানচরে নজরদারি বাড়ানো ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই।
ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিচালক ও নৌবাহিনীর কমোডোর রাশেদ সাত্তারের মতে, ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্পটি উদ্বাস্তুদের জন্য স্বর্গতুল্য। পৃথিবীর কোথাও শরণার্থীদের এত আধুনিক সুযোগ-সুবিধা দেয়ার নজির নেই। প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালে ২৫ আগস্টে কোরবানি ঈদের মাত্র কয়েকদিন আগে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক নিপীড়নমূলক অভিযান শুরু করে। এর ফলে প্রাণ বাঁচাতে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। পুরনোসহ উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি শিবিরে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। পরবর্তীতে কক্সবাজার থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে সরিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে একটি প্রকল্প নেয় সরকার। আশ্রয়ণ-৩ নামে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে। এর অংশ হিসেবে গত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কয়েক দফায় স্বেচ্ছাগামী প্রায় ১৯ হাজার রোহিঙ্গা সেখানে পৌঁছে দালানের এক একটি ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেয়া হয়। রোজার পর সেখানে অবস্থানকারীদের জন্য উৎসবমুখর ভাবে ঈদের জামায়াত ও নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published.