চাঁদা তুলে তাঁর মাসে আয় ২১ লাখ টাকা

শাহাদাত স্বপন ॥ একেই বলে উড়ে এসে জুড়ে বসা! বাস মালিকের। রাস্তায় চলার অনুমতি দেয় সরকারের সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। কিন্তু রুটে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে নিজের নামসর্বস্ব ব্যানারে অন্যদের গাড়ি চালাতে বাধ্য করে চলছে প্রভাবশালী মহলের দুর্বৃত্তায়ন। ‘কতিপয় নামমাত্র ব্যানার মালিক ও মালিক সমিতির নেতার’ দৌরাত্ম্যে অনেক বাস মালিক কোটি টাকায় বাস নামিয়েও যেমন চোখে অন্ধকার দেখছেন, যাত্রীদের গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা।
টিকিটপ্রতি ৮০ থেকে ১০০ টাকা, রুটভেদে যা আরো বেশি! এ রকমই একটি নাম দেলোয়ার হোসেন। ঢাকা-নোয়াখালী-ফেনী-লক্ষ্মীপুর আন্ত জেলা বাস মালিক সমিতির সেক্রেটারি এবং ঢাকা এক্সপ্রেসের মালিক দেলোয়ারের এই চাঁদাবাজি থেকে আয় প্রায় ২১ লাখ টাকা। আর তাঁর এই দৌরাত্ম্য চলছে রাস্তার কথিত ‘চাঁদা, সার্জেন্ট ও জিপি’র (নামস্বর্বস্ব ব্যানার) নামে। দেলোয়ারের প্রভাব এমনই যে অনেক বাস মালিক বিআরটিএ থেকে রুট পারমিট নিয়েও গাড়ি নামাতে পারছেন না।
সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খান, ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এনায়েত উল্লাহ খানসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কালের কণ্ঠকে বলছেন, চাঁদাবাজির ঘটনা সত্য, মালিক-যাত্রী সবার স্বার্থেই এটি বন্ধ করতে হবে। ঢাকা-লক্ষ্মীপুরের ওই রুট শুধু নয়, দেশের বেশির ভাগ রুটেই চলে আসছে এমন নৈরাজ্য। নামমাত্র ব্যানার ও সমিতির নেতৃত্বে এসে কিছু ব্যক্তি আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে।
কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানী সেলের অনুসন্ধানে মিলেছে ঢাকা-নোয়াখালী-ফেনী-লক্ষ্মীপুর রুটের একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য—দিনে প্রতিটি গাড়ি থেকে নেওয়া হয় দুই হাজার ৩৭০ টাকা! ৮১৮৬ সিরিয়ালের একটি বাস ঢাকা থেকে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের উদ্দেশে ছেড়ে যায় গত ১৫ জুলাই। সুপারভাইজর ছিলেন তানভীর হোসেন নামের এক ব্যক্তি। তিনি দিনের খরচের একটি লিখিত হিসাব জমা দিয়েছেন ঢাকা এক্সপ্রেসের অফিসে। রাস্তায় চাঁদা ৬২০ টাকা, জিপি এক হাজার ২০০ টাকা ও সার্জেন্ট (পুলিশ) ৫৫০ টাকা! এভাবে শুধু ঢাকা থেকে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরগামী ৩০টি বাসের মালিকরা প্রতিদিন ৭১ হাজার ১০০ টাকা চাঁদা দিতে বাধ্য হচ্ছেন। যদিও ট্রাফিক পুলিশ বলছে, এ বিষয়ে তারা কিছুই জানে না।
ঢাকা এক্সপ্রেসের ব্যানারে চলা বাসটির সুপারভাইজর তানভীর হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে অনুসন্ধানী সেল। তিনি বলেন, ‘প্রতি গাড়ি থেকে ঢাকা এক্সপ্রেসের অফিসে দুই হাজার টাকা জমা দিতে হয়। আর রাস্তায় খরচ হয় দুই থেকে তিন শ টাকা। রাস্তায় যে খরচ হয় তা আমরা পরিশোধ করি। কিন্তু কোন কারণে অফিসে দেলোয়ার সাহেবের লোকেরা প্রতিটি গাড়ি থেকে এ টাকা নেন, সেটা আমার জানা নেই।’ তিনি এসব কথা গণমাধ্যমে এলে তাঁর চাকরি থাকবে না বলেও আশঙ্কা করেন।
দেলোয়ার হোসেন বছর দশেক আগে ‘ঢাকা এক্সপ্রেস’ নামের ব্যানারটি চালু করে আনুমানিক দুই থেকে তিন হাজার টাকা ব্যয়ে। সেই ব্যানারে গত ১০ বছরে তিনি তুলে নিয়েছেন শতকোটি টাকা। ‘একুশে পরিবহন’ ও ‘সেন্ট মার্টিন ট্রাভেলস’সহ বেশ কিছু পরিবহনের ব্যানারে দেদার চলছে তার ‘জিপি চাঁদাবাজি’।
জানা গেছে, ঢাকা থেকে লক্ষ্মীপুরের রায়পুর রুটে নিজস্ব ব্যানারে গাড়ি চলাচলের জন্য আবেদন করে পাত্তাই পাচ্ছেন না ‘টি-আর ট্রাভেলস’ কর্তৃপক্ষ ইমন, বাসু ও বিলাস প্লাস ট্রাভেলসের মালিক মো. হাসানুল আমিন। তাঁরা অভিযোগ করেছেন, ঢাকা-নোয়াখালী-ফেনী-লক্ষ্মীপুর আন্ত জেলা বাস মালিক সমিতির সেক্রেটারি দেলোয়ার হোসেন ক্ষক্ষমতার অপব্যবহার করে জোরপূর্বক ওই রুটে তাঁদের গাড়ি ঢুকতে দিচ্ছে না।
এদিকে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি-বিআরটিএ থেকে রুট পারমিট নিয়েও লক্ষ্মীপুরের রায়পুর রুটে গাড়ি নামাতে পারছেন না ‘টি-আর ট্রাভেলস’ কর্তৃপক্ষ ইমন, বাসু ও বিলাস প্লাস ট্রাভেলসের মালিক মো. হাসানুল আমিন। দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কাছে একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন হাসানুল আমিন। হাসানের অভিযোগ, দেলোয়ার তাঁদের প্রস্তাব দিয়েছেন, তাঁকে চাঁদা পরিশোধ করে জিপিতে গাড়ি চালাতে হবে। আর নিজেদের ব্যানারে গাড়ি চালাতে চাইলে গুনতে হবে বড় অঙ্কের টাকা।
পরিবহনের শাখা সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন অবৈধভাবে এমন চাঁদা নিতে পারেন না বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সায়েদাবাদ আন্ত জেলা বাস মালিক সমিতির এক নেতা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘চাঁদা আদায়ের অভিযোগে সারা দেশে এসব সংগঠন বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে চাঁদা আদায় না করার প্রতিশ্রুতিতে এসব সংগঠনের কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। সরকারের অনুমতি থাকার পরও রাস্তায় গাড়ি চালাতে না দিলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’সরকারের সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএ বলছে, রাস্তায় গাড়ি চলবে কী চলবে না, তা দেখার দায়িত্ব তাদের। পরিবহন মালিক সমিতিগুলো শুধু রাস্তায় গাড়ি পরিচালনায় শৃঙ্খলার বিষয়টি দেখবে। রোড সেফটি উইংয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত বিআরটিএর পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যদি কোনো সমিতি রাস্তায় গাড়ি চলতে টাকা নেয় তা অন্যায়, আইনবর্জিত। কোনোভাবেই সমিতি বা কথিত কোনো ব্যানার মালিক গাড়ির মালিকদের কাছে টাকা নিতে পারে না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মালিক সমিতির এক নেতা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, “একুশের ট্রাভেলস ও সেন্ট মার্টিন এক্সপ্রেসসহ আরো বেশ কয়েকটি ব্যানার মালিক প্রতিনিয়ত ‘জিপি’তে গাড়ি পরিচালনা করছে। আর এসব গাড়ি থেকে প্রতিদিন পুলিশের নামে চাঁদা নেওয়া হয়। আমরা প্রায় চার দশক ধরে এই ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিভিন্ন সময় সমিতির নেতৃত্বও দিয়েছি। এর আগে কখনো এত খারাপভাবে চাঁদাবাজি দেখিনি। কারা এসব সমিতির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকে চাঁদাবাজিকে পৃষ্ঠপোষকতা করে সুবিধা নিচ্ছে, তাও সবাই জানে। তদন্ত করলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে।”
পুলিশের সার্জেন্টের নামে প্রতিটি গাড়ি থেকে ৫৫০ টাকা হারে কেন চাঁদা আদায় করা হচ্ছে এমন প্রশ্ন ছিল ট্রাফিক পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মনিবুর রহমানের কাছে। তিনি বলেন, ‘পুলিশ কখনোই এ ধরনের কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত নয়। আমাদের কাছে যদি কেউ এ অভিযোগ দেয়, তাহলে তা তদন্ত করা হবে। গাড়ির মালিকদের কাছ থেকে চাঁদা নিয়েছে ট্রাফিক পুলিশ, তদন্তে তা প্রমাণিত হলে অবশ্যই বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আবার যদি কোনো ব্যক্তি চাঁদার টাকা নিয়ে থাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে। ভুক্তভোগীর উচিত, আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ করা।’
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং এনা পরিবহনের স্বত্বাধিকারী এনায়েত উল্লাহ বলেন, চাঁদাবাজির ঘটনা সত্য। তবে ভুক্তভোগীরা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করলে অবশ্যই এসব চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অভিযোগ করলেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না—এ প্রসঙ্গে এনায়েত বলেন, ‘অনেক সময় অভিযোগকারীরা ভয়ে অভিযোগ করেন না। তাঁদের ধারণা অভিযোগ করলে তাঁদের গাড়ি বন্ধ করে দেওয়া হবে। আমি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনুরোধ করব, আপনারা অভিযোগ করুন, ব্যবস্থা অবশ্যই হবে।’ উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘চাঁদাবাজির অভিযোগে মিতালী পরিবহন মলিক সমিতি বিলুপ্ত করা হয়েছে। মঙ্গলবার সেখানে আমরা একটি আহ্বায়ক কমিটি দিয়েছি।’
সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খান এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘চাঁদাবাজির ঘটনা সঠিক। পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে বরাবরই আমি সোচ্চার ছিলাম। আগের চেয়ে চাঁদাবাজি কমেছে। তবে এখনো শেষ হয়নি। রাস্তায় এমন চাঁদাবাজির প্রমাণ আমার কাছেও আছে। আপনাদের গণমাধ্যমে এসব তুলে ধরলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হয়।’ এসব চাঁদাবাজকে রুখতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা উচিত বলেও মত দেন সাবেক এ মন্ত্রী।
পরিবহন সেক্টরে এমন প্রকাশ্য চাঁদাবাজি বন্ধ হলে দেশের মানুষ যেকোনো প্রান্তে যাতায়াতে টিকিটপ্রতি ৮০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত কম ভাড়ায় চলতে পারবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ঢাকা-নোয়াখালী-ফেনী-লক্ষ্মীপুর আন্ত জেলা বাস মালিক সমিতির সেক্রেটারি এবং ঢাকা এক্সপ্রেসের মালিক দেলোয়ার হোসেনের কাছে চাঁদা গ্রহণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ‘এ বিষয়ে আমি ফোনে কথা বলতে আগ্রহী নই। আপনি বরং আমাদের অফিসে আসুন, তখন কথা বলব।’ ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন করলেও তিনি একই কথা বলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.