বা আ ॥ ‘নদী ভাঙন নিয়ে আর কী বলব। পাঁচ তলা পাকা বাড়ি, দোকানপাট, স্বাস্থ্য ক্লিনিক- কিছুই রক্ষা পায়নি নদী ভাঙনের হাত থেকে। এই তো ২০১৮ সালেও সাড়ে ৬ হাজার ঘরবাড়ি, মসজিদ, মাদরাসা নদীগর্ভে চলে গেছে। চোখের সামনে ভেসে গেছে কতজনের মা-বাবাসহ আত্মীয়স্বজনের কবর। এলাকার মধ্যে ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান আমরা। একসময় অনেক কিছুই ছিল। বলতে গেলে এখন নিঃস্ব।’ ঠিক এভাবেই নদী ভাঙনের বর্ণনা করছিলেন কেদারপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ইমাম হোসেন দেওয়ান।
ইমাম হোসেন দেওয়ান মুলফৎগঞ্জ এলাকার ঐতিহ্যবাহী দেওয়ান পরিবারের সন্তান। এলাকায় সবচেয়ে বড় বংশ হিসেবে তাদের পরিচিতি। একসময় বাপ-দাদার বিশাল সহায়-সম্পত্তি ছিল। নদীগর্ভে সবই এখন বিলীনপ্রায়। সোমবার নদী ভাঙন নিয়ে তার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা হয়। ৬৪ বছর বয়সী সাবেক এই জনপ্রতিনিধি জানালেন, স্বাধীনতার পর থেকেই সর্বনাশা পদ্মা নদীর ভাঙন দেখে আসছেন। তবে আশার কথা, গত দুই বছর একটি বাড়িও ভাঙেনি। ৫০ বছরের ভাঙনকবলিত এলাকা এখন পরিণত হয়েছে নিরাপদ বসবাসের স্থানে। গড়ে উঠেছে অট্টালিকা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। পরিণত হয়েছে পর্যটন কেন্দ্রে। এ জন্য সাবেক এই চেয়ারম্যান বললেন, স্থানীয় এমপি ও পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীমের কল্যাণেই এখানকার মানুষ নদীভাঙন থেকে রক্ষা পেয়েছে। সরেজমিন নড়িয়ার নদীভাঙন এলাকা বাঁশতলা, মুলফৎগঞ্জ, কেদারপুর, চন্ডীপুর, সুরেশ্বর এলাকা ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্ষা এলেই পদ্মা পাড়ের মানুষের মনে জাগত ভাঙনের আতঙ্ক, আর্তনাদ ও হাহাকার। একসময়কার কোটি টাকার মালিক নদীভাঙনে হয়েছের নিঃস্ব। এমন পরিবার আছে শত শত। বর্ষা এলেই এ এলাকার মানুষ ভাঙন আতঙ্কে পরিবার নিয়ে ঘরবাড়ি সরিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিত। প্রমত্তা পদ্মার ভাঙা-গড়ার সঙ্গে দিন-রাত লড়াই করে যারা কোনোরকমে বেঁচে থাকার চিন্তা করতেন, সে জায়গায় ভাঙন রোধ হয়ে এখন পরিণত হয়েছে ভ্রমণপিপাসুদের পর্যটন কেন্দ্রে।
স্থানীয়রা জানান, শুধু ২০১৮ সালেই এসব এলাকায় সাড়ে ৬ হাজার পরিবার নদীভাঙনের শিকার হয়। নদীগর্ভে বিলীন হয় পাকা ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, হাট-বাজার, গাছপালা, ফসলি জমি, মসজিদ-মন্দির, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান। সেই জায়গায় এখন ভাঙন রোধ হয়ে গড়ে উঠেছে মানুষের নিরাপদ আবাসস্থল। আর পদ্মা নদীর ডান তীর রক্ষা বাঁধ যেন এখন পর্যটন নগরী। প্রতিদিনই শত শত লোক নদীর পাড়ে ঘুরতে আসছেন। কেদারপুর গ্রামের গৃহিণী আসমা আকতার বলেন, ‘নদীভাঙন ছিল আমাদের নিত্য সঙ্গী। ২০১৮ সালেই কেদারপুরে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ঘরবাড়ি নদীতে চলে গেছে। সে সময় আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম। তার মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত বেগম আশ্রাফুন্নেছা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রতিটি বাড়িতে প্রয়োজনীয় খাদ্য, বস্ত্রসহ সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন তিনি। এমপি ও উপমন্ত্রী হওয়ার পর নদীভাঙন রোধে স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। এখন আর কোনো মানুষকে নদীভাঙনে চোখের পানি ফেলতে দেখা যায় না।’
এ প্রসঙ্গে শরীয়তপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি নিজেও নদীভাঙন এলাকার মানুষ। নদীভাঙনের শিকার মানুষের কষ্টটা আমি বুঝি। দীর্ঘ ৫০ বছরের ভাঙন রোধ করা সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণেই। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এলাকার মানুষকে নদীভাঙন থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘শুধু আমার নির্বাচনী এলাকাই নয়, সারা দেশেই নদীভাঙন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। নদীর বুকে যেন আর কোনো ঘরবাড়ি বিলীন না হয়, আমরা সে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি।’ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীমের উদ্যোগে নড়িয়া-জাজিরার পদ্মা নদীর ডান তীর রক্ষা প্রকল্প নামে ১ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি মেগা প্রকল্পের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। ওই প্রকল্পে ব্যবহারের জন্য সিসি ব্লক নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে নদীতীরবর্তী ১০টি স্থানে। এর মধ্যে কাজ শেষ হয়েছে নড়িয়ার নদীভাঙন এলাকা বাঁশতলা, মুলফৎগঞ্জ, কেদারপুর, চন্ডীপুর, সুরেশ্বর পর্যন্ত।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ফরিদপুর জোনের প্রধান প্রকৌশলী আবদুল হাকিম বলেন, ‘প্রকল্পের ৭০ ভাগ কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। আগামী জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। এর ফলে নড়িয়া-জাজিরার মানুষ নদীভাঙন থেকে স্থায়ীভাবে রক্ষা পাবেন বলে আশা করছি।’ বর্ষাকালে ভাঙন যেখানে নিত্যসঙ্গী সেখানে এখন পর্যটন কেন্দ্র। বিকালে মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুরতে আসেন। নদীর পাড়ে বাতাস খান। কথা হয় পদ্মার ডান তীর রক্ষা বাঁধে ঘুরতে আসা শিপনের সঙ্গে। তিনি বললেন, একজন রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধির সদিচ্ছা থাকলে অসাধ্যকে সাধন করা সম্ভব। এ জন্য চাই কমিটমেন্ট। স্থানীয় এমপি এনামুল হক শামীম তেমনই একজন। তার উদ্যোগেই নদীভাঙন রোধ হয়ে এখন পর্যটন কেন্দ্র হয়েছে। জানা গেছে, দীর্ঘ ৫০ বছরের ভাঙন থেকে রক্ষা পাওয়ায় কৃতজ্ঞতা জানাতে আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর এলাকাবাসী নদীর পাড়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘায়ু কামনায় দোয়া, আলোচনা সভা ও বিশেষ মোনাজাতের আয়োজন করেছেন। এতে সভাপতিত্ব করবেন স্থানীয় এমপি এনামুল হক শামীম। প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি যোগদান করবেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। পদ্মার ভাঙন প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক, নড়িয়া পৌরসভার মেয়র অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ বলেন, বর্ষা এলেই এখানে মানুষের যে আর্তনাদ, যে আতঙ্ক ছিল, সে বিষয়গুলো এখন আর নেই। ভাঙনকবলিত এলাকার লোকগুলো বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই লোকগুলোকে গৃহায়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে আশ্রয় দিয়েছেন।